বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন-

রিমোট নিয়ে টিভি দেখতে বসলে মনে হয় আমি ভারতে আছি, বাংলাদেশে না।আমার বাসার টিভিতে সর্বমোট ১০০ টি চ্যানেল আসে তারমধ্যে ৪৭ টি চ্যানেল সরাসরি ভারতীয় এবং আরও দশটি চ্যানেল আছে যেগুলো ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। মানে ১০০ টির চ্যানেল এর মধ্যে ৫৭ টি ভারতীয় চ্যানেল। পৃথিবীতে মনে হয় বাংলাদেশ'ই একমাত্র দেশ যে দেশে নিজেদের টিভি চ্যানেলের থেকে প্রতিবেশী দেশের টিভি চ্যানেলের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। নিজের দেশে থেকে যদি ৫৭ টি চ্যানেল অন্য দেশের দেখতে হয় তাহলে আমি কিভাবে বুঝবো আদৌ আমি আমার দেশে আছে কিনা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশী কোন টিভি চ্যানেল ভারতে প্রচার হয় না। কোথাও দু-একটি হতে পারে কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক না। বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল ভারতে যে প্রচারে বাধা আছে তা কিন্তু না। ভারত তো আর আমাদের মত বোকা না, তারা তাদের দেশের স্বার্থটা সবার আগে দেখে। যদিও বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের প্রতি ভারতীয় বাঙালিদের যথেষ্ট আগ্রহ আছে।কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারের যে নীতিমালা সেটা পালন করে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল সেখানে প্রচার করা প্রায় অসম্ভব। তাদের সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী আবেদনকারী কোম্পানিকে প্রথমে টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় টাকা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি অতিরিক্ত চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ভারতীয় টাকা নেট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই মূল্য ছাড়াও ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় টাকা ফি দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় টাকা দিতে হবে। ডাউনলিংকের নিবন্ধন ও অনুমতি ১০ বছর বহাল থাকবে। তাই এতটাকা ফি দিয়ে ভারতীয় কোন ক্যাবল অপারেটর বাংলাদেশি চ্যানেল প্রচারে আগ্রহী না। আর বাংলাদেশে ভারতীয় যে চ্যানেলগুলো প্রচার হয় তা এক রকম ফ্রিতেই প্রচার হয় বলা চলে। সম্প্রতি একটি জরিপের রিপোর্টে দেখা গেছে, ‘বাংলাদেশে টেলিভিশন দেখেন এমন নারীদের ৬৬ শতাংশের বেশি অধিকাংশ সময় ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেখেন। তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে স্টার জলসা। বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ নারী দর্শক নিয়মিত এই চ্যানেলটি দেখেন।’জরিপটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ। আমরা ভারতীয় সস্তা, থার্ড ক্লাস টিভি সিরিয়াল দেখার জন্য রিমোট নিয়ে ঝগড়া করি। এই দেশের মেয়েরা ভারতীয় সিরিয়ালের ড্রেস কিনতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। কত সস্তা জীবন আমাদের!! বিয়ে,জন্মদিন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উৎসবে ভারতীয় গান না চললে সেই উৎসব পরিপূর্ণণ হয় না। এমনকি আমাদের জাতির পিতার শোক দিবস সহ ২১ শে ফ্রেব্রয়ারীতেও হিন্দি গান বাজানো হয়। আমরা তাদের ২০ মিনিটের সিরিয়ালে অনেক সময় ১৮ মিনিট'ই পূজা অথবা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখি খুবই আনন্দ এবং আগ্রহের সাথে। আর আমাদের দেশের কোন নাটকে যদি ইসলাম ধর্মের কথা এক মিনিটও থাকে তাহলে দেখবেন আমাদের প্রগতিশীলতা এবং সেকুলারিজম গেলো গেলো বলে মানুষ চিৎকার শুরু করে দিবে,কারন আমরা প্রগতিশীল এবং সেক্যুলার দেশ। আমাদের যুব সমাজের আজকের এই যে নৈতিক অবক্ষয় তার জন্য ভারতীয় সংস্কৃতি এবং মিডিয়া অনেকাংশে দায়ী। কারন ভারতীয় মিডিয়ার কাছে নারী মানে পণ্য, নারী মানে ভোগের জিনিস, নারী মানে ছোট ছোট কাপড় পরিয়ে আইটেম গানে নাচানো। আর এই গুলো আমাদের যুব সমাজের উপর মারাত্মক রকম প্রভাব ফেলছে। বছর দুয়েক আগে বিবিসি হিন্দি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কোন একটি বিষয়ের উপর কিছু ছাত্রছাত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।সেখানে সাক্ষাৎকার দেয়া প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রী অনর্গল হিন্দিতে কথা বলেছে।তারা একবারের জন্য ভাবে নাই এভাবে তারা নিজের দেশকে অন্য দেশের কাছে ছোট করতেছে।তারা ভাবে নাই কারণ তারা এভাবেই বেড়ে উঠেছে।আমাদের ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমাতে যাওয়ার মাঝে এই সময়টু পুরোপুরো ভারতীয় সংস্কৃতির দখলে। এখন একজন মানুষ যখন দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময়ই ভারতীয় সংস্কৃতি দেখে বড় হবে তখন তার তো সেই সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক এবং সেই দুর্বলতা থেকে সে যদি হিন্দিতে কথা বলে তার কাছে এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হবে না।নিজের দেশে থেকে যদি ৫৭ টি চ্যানেল ভারতেরই দেখতে হয় তাহলে মানুষের হিন্দিতে কথা বলাটাই স্বাভাবিক । কয়েকটা মুভি গ্রুপে নিয়মিত লেখালেখি করি সেই সুবাদে দেখতে পাই অনেক মানুষ নিয়মিতই জিজ্ঞেস করে মুভির হিন্দি ডাবিং আছে কিনা। এ থেকে বোঝা যায় আমরা কতটা হিন্দি ভাষায় এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের দেশের মানুষ এবং আমাদের আবাল মিডিয়া ভারতীয় মিডিয়ার লোকজনদের যতটা খোজ খবর রাখে খুঁত ভারতীয় মানুষও মনে হয় এতটা খোঁজ খবর রাখে না।কোন নায়িকার দাঁতের সমস্যা, কোন নায়িকার ঠোঁটে সমস্যা, কোন নায়ক-নায়িকা কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেছে, কোন নায়কের ছেলে-মেয়ে কার সাথে প্রেম করে এসব হাস্যকর নিউজ গুলো আমাদের দেশের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যম কাভার করে। এই সব কিছু দেখলে আমার ভারতের সিকিম রাজ্যের কথা মনে পড়ে যায়। সিকিমের কথা কেন বললাম এটা গুগলে সার্চ দিলেই বুঝতে পারবেন। ভারতীয়রা কিন্তু আমাদের মত বোকা আর আবালচোদাদের খোঁজ খবর রাখে না (পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টা আলাদা হতে পারে)। ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখেছিলাম যার বিষয় ছিল "ভারতীয়রা বাংলাদেশী সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে"। যে কয়জন ওখানে কথা বলেছিল তাদের প্রায় সবারই বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা ছিল জঘন্য রকম খারাপ।বাংলাদেশকে তারা একটি অত্যন্ত গরীব এবং সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি এবং মুদ্রার নাম কি সেটাও তারা প্রায় কেউ জানেই না। পাকিস্তান সম্পর্কে কিন্তু তাদের ধারণা বেশ ভালো এবং তাঁরা পাকিস্তানের খোঁজ-খবরও রাখে। যদিও তারা পরস্পরের শত্রু দেশ বলেই আমরা জানি, আর আমরা হলাম ভারতের বন্ধুপ্রতিম দেশ।এই বন্ধুপ্রতীম দেশের দ্বারা সীমান্তে হত্যা, পানি সমস্যা, দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ক্রিকেট খেলায় তাদের অনৈতিক মাতাব্বরি ইত্যাদি নিয়ে কথা বললে তো আমার চাকরি'ই থাকবে না। প্রতিবেশী দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের সম্পর্কে এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখা উচিত। কিন্তু সেটা কখনোই একতরফা বা এত বাড়াবাড়ি রকমের হওয়া উচিত না। আমাদের এই একতরফা ভারত নীতি,একতরফা ভারত প্রীতির এবং অতি ভারত নির্ভরশীলতার কারণে ভারতীয় মানুষ এবং ভারতীয় প্রশাসন বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে। এই অতি ভারতপ্রীতির ফলে আমরা প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসেছি আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে। ভারত ছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী বা আশেপাশের আরো অনেক দেশ আছে আমরা সবার সংস্কৃতি এবং তাদের দেশ সম্পর্কে জানতে চাই। টিভি খুললেই কেন শুধু ভারতীয় চ্যানেল চোখে পড়বে!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.