পরিক্ষার খাতা দেয়া... শিক্ষকদের হাতে মাইর খাওয়া এবং বাসার আতংক

আমি দাখিল (এসএসসি) পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষে কিছু দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়া হতো।বন্ধ শেষে খোলার পর পরিক্ষার খাতা দেয়া হতো। ওই খাতা দেয়ার দিনগুলোতে খুবই উদ্বিগ্নে থাকতাম।সকালে মাদ্রাসার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতাম আর দেখতাম "যে বিষয়ে পরিক্ষা খারাপ হয়েছে সেই বিষয়ের স্যার হাতে করে খাতা আনে কিনা"। আবার অনেক সময় শিক্ষকদের রুমে গিয়ে খোঁজ নিতাম আজকে ওই স্যার খাতা দিবে কিনা।

যদি নিশ্চিত হতাম আজকে খাতা দিবে না তাহলে একদিনের জন্য হাফ ছেড়ে বাঁচতাম।আর যদি শুনতাম যে আজকে স্যার খাতা দিবে তাহলে ওই দিন ওই ক্লাসের আগ পর্যন্ত অসম্ভব রকম ভয়ে থাকতাম।আল্লহর কাছ দোয়া করতাম ওই ক্লাসের আগে যেন মাদ্রাসা ছুটি হয়ে যায়...অথবা চেষ্টা করতাম ওই ক্লাসের আগে মাদ্রাসা থেকে পলাতে বা হোস্টেলের কোন রুমে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু এই এগুলোর কোনটাই সব সময় হতো না...তাই মাইর খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম।

ক্লাসে শিক্ষক খাতা দিতো রোল নম্বর অনুযায়ী। কখনো প্রথম থেকে কখনোবা উল্টো দিক থেকে।যেভাবেই দিতো, ধিরে ধিরে যখন আমার রোলের দিকে এগিয়ে আসতো তখন মাইরের ভয়ে আমার হৃদপিণ্ড বুক থেকে বেরিয়ে যেতে চাইতো।
কি মাইর'টাই না খেতাম....ভাভাগো..ভাভা, হাতের তালু এবং পিঠ ফুলে যেতো।মাদ্রাসার পাশেই কিছু গাছ ছিল, গ্রামীন ভাষায় যেটা পিটকুলি এবং ছিটকি গাছ।সেই গাছের ডাল কয়েকটি একত্র করে তারপরে আমাদের পেটানো হতো। অনেক শিক্ষক আসার সময় অফিস থেকে বেত নিয়ে আসতো, চকচকে মোটা বেত। দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু এগুলো দিয়ে মাইর খেতে খুব ব্যাথা লাগতো।বেত অথবা গাছের ডাল মাইর দেয়ার এইসব উপকরণ আনার দ্বায়িত্ব‌ থাকতো ক্লাসের ফাষ্ট বেঞ্চাদের‌ উপর।

মাইর খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে মনে হতো এই শিক্ষকদের সাথে হয় আমাদের কোন পূর্ব শত্রুতা আছে, নাহলে তারা বাড়িতে ঝগড়া করে এসে সেই রাগ আমাদের ওপর জারে...এতো নির্মম ভাবে আমাদের পিটাতো।

মাদ্রাসার দু মিনিটের দূরত্বে একটি স্কুল আছে। যেখানে আমার ভাই-বোন এবং বন্ধুরা পড়তো।সেই স্কুলে বেত দিয়ে পিটানো ছিল খুবই বিরল ঘটনা। আমি শুনেছি এবং জানিও অনেক ছাত্র মাইর খেয়ে মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছে।

শুধু খাতা দেয়া না, ক্লাসে পড়া না পারলেও একই ভাবে মাইর দেয়া হতো। মাঝে মাঝে মাইরের ভয়ে মাদ্রাসার হোস্টেলে যেয়ে ওই ক্লাসের সময় লুকিয়ে থাকতাম।সব শিক্ষক কিন্তু মাইর দিত না, নির্দিষ্ট সাবজেক্টের নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষক মারতো।মাইর দিতো না এমন শিক্ষকদের সংখ্যাই বেশি ছিল।

যাইহোক,খাতার জন্য মাদ্রাসায় মাইর খেয়ে বাড়িতে ফিরেও শান্তি পেতাম না।পরীক্ষার খাতা বাসায় এনে কোন গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু জানি খাতা দিছে কিনা এটা আব্বা জিজ্ঞেস করবেই।তাই ওই সময় কিছুদিন আব্বার কাছে থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম।

সমস্যা হতো বেশি রাতের বেলায়। কারণ তখন আব্বা অফিস থেকে বাসায় ফিরত। আমি ইচ্ছে করেই রাতের খাবার খুব দ্রুত শেষ করে সবার আগে উঠে যেতাম। অথবা খাবারের মুহূর্তে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অহেতুক কথা উঠাতাম।যাতে পরিক্ষার খাতা দিয়েছে কিনা এই কথা আব্বা বলার সুযোগ না পায়। যদি কখনো জিজ্ঞেস করতো "তখন সবকিছু অন্ধকার হয়ে যেতো... ভয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখতাম।এই ভয় অবশ্য মাইরের ভয় না....এটা হলো শ্রদ্ধার ভয়.... যেটা মাইরের থেকে কঠিন।

নোট:আমি মাদ্রাসা শিক্ষকদের খারাপ বলছি না।আমি শুধুমাত্র আমার স্মৃতি লিখে রাখলাম। আমি বরং ছাত্রদের বেত দিয়ে পিটানোর পক্ষে। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় যখন শিক্ষকরা ছাত্রদের পেটাতো.. তখন ছাত্ররা শিক্ষকদের  এবং বড়দের অনেক সম্মান করত। এখন দিন দিন পরিস্থিতি উল্টো দিকে যাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.