হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে আটকে পড়ার স্মৃতি

কখনো কি হঠাৎ নেমে আসা ঝুম বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলেন...বহুদূরে... দীর্ঘ সময়ের জন্য?? আমি একবার এইরকম অবস্থায় পড়েছিলাম।

বেশ কয়েক বছর আগে কথা.....দশ বছর তো হবেই। বেশ আগের কথা হলেও  এখনো আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে, কারণ সময়টা ছিল অদ্ভুত রকমের ভালো লাগার। তখন আমাদের এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না।বংশী নদী দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিল আমাদের এলাকা থেকে সাভার বাজার যাওয়া সবচেয়ে সহজ উপায়।

বাসা থেকে বের হয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর বংশী নদীর ধারে এসে সাভার বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া নৌকায় উঠতে হতো।নৌকা বাজারের উদ্দেশ্যে ছাড়ার পর সেটা নদীর দু'পাশের আরো কয়েকটা ঘাটে ভীড়ে সেখান থেকে মানুষ নিয়ে চলতে থাকত।কেউ বাজার করার উদ্দেশ্যে বের হতো... কেউবা বাজারে কোন পন্য বিক্রির উদ্দেশ্যে বের হতো।

"বংশী নদীর পশ্চিম পাশে ধামরাই, আর পূর্ব পাশে সাভার। নদীর ওই পারে অর্থাৎ পশ্চিম পাশের মানুষগুলো তুলনামূলক অনেক অনেক সহজ সরল, দরিদ্র, কৃষিজীবী এবং পরিশ্রমী মানুষ।ওই পাড়ের এলাকা এবং মানুষগুলো ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ভালো লাগতো।কারণ আগেই বলেছি তারা অনেক সহজ সরল এবং ওই এলাকাটা মূলত কৃষি প্রধান এলাকা। তারা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি চাষ করে।তারা  বিভিন্ন ধরনের তাজা সবজি এবং বিভিন্ন কিছু সাভার বাজারে নিয়ে যেত বিক্রি করার জন্য। আর এই পাড়ের মানুষ সেইগুলোই বাজার থেকে কিনে আনতো।"

বাজারে যাওয়ার সময় কারো কারো পকেটে থাকো লম্বা বাজারে লিষ্ট আর হাতে থাকতো বাজার আনার ব্যাগ। আমার আব্বা পকেটেও ওইরকম বিশাল লম্বা একটি বাজারের লিষ্ট থাকতো।এই লিষ্ট আমিই লিখে দিতাম। সকালে বাজারে যাওয়ার আগে কি কি লাগবে সেটা আম্মা বলতো আর আমি সেগুলো লিষ্ট করতাম।এই সুযোগে আমার নিজের কিছু জিনিস অথবা খাবারের নামও লিষ্ট উঠিয়ে দিতাম।

লিখার পর যখন লিষ্ট পড়তে বলতো তখন আমার জিনিসগুলোর নাম স্কিপ করে বাকি গুলোর পড়তাম।জানি, বাজারে গিয়ে লিষ্ট দেখলে আব্বা এগুলো আনবেই।আব্বা শনিবার বাজারে যেত, কারণ ওই দিন ছিল সরকারি ছুটি। আমিও সাথে যাবার জন্য খুব বায়না করতাম। কিন্তু সেটা সব সময় সম্ভব হতো না।কারণ শনিবার স্কুলে ক্লাস থাকতো।তবুও আমি যাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করতাম, মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করতাম।

কারণ বাজারে যাওয়া মানেই একদিন ক্লাস মিস... আর ক্লাস মিস মানে... আহ্ কত আনন্দ।তবে বেশিরভাগ সময়ই আমি সফল হতাম না। আব্বা বাজার থেকে বিভিন্ন মজা (অনির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্যকে আমরা ছোটবেলায় মজা হিসেবে ডাকতাম) আনার লোভ দেখিয়ে রেখে যেতো। আর আমি সেই মজা খাওয়ার লোভ নিয়ে ভাঙ্গা মনে এক পা দু পা করে স্কুলের দিকে হাঁটা দিতাম। যেতে অবশ্য একটুও ভালো লাগতো না। যদিও স্কুল বাসা থেকে এক মিনিটের পায়ে হাঁটার দুরত্বে।

সাভার বাজারের হাটের দিন ছিল সপ্তাহে দুদিন, শনিবার এবং মঙ্গলবার।বহুদূর থেকে মানুষ এই দুই দিন বাজারে আসতো।কেউ কিনতে আবার কেউ বিক্রির উদ্দেশ্যে আসতো।এই দুইদিন হাটের দিন হওয়াতে নৌকায় বসার জায়গা পাওয়া যেত না। নৌকায় উঠে মানুষ একে অপরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে গল্প করতে থাকতো। বাজার বা পন্য সম্পর্কিত কথাই বেশি হতো। যেমন, কোনটার দাম বেশি, কোনটার দাম কম,কে বাজার থেকে কি আনবে, বাজারে পরিস্থিতি বা অনেক সময় দেশের পরিস্থিতি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কথা বেশ জোরে বলতে হতো, কারণ আস্তে বললে ইঞ্জিনের শব্দের কথা বুঝা যেতো না।

বংশী নদীর টলমলে পানি বয়ে নৌকা চলতে থাকতো বাজারের উদ্দেশ্যে। কখনো হঠাৎই নদীতে দেখা যেতো শিশু (আসলে এর নাম শুশক, তখন বুঝতাম না,জানতাম এর নাম শিশু।পরে জানলাম এটা ডলফিনের একটা প্রজাতি),কখনোবা আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে চলে যেত বিশাল বিশাল ট্রলার, যা পাশ দিয়ে গেলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠতো। আবার কখনো দেখা যেতো জেলেদের মাছ ধরায় দৃশ্য, কখনোবা দেখা যেতো কোন কৃষক তার গরুকে নদীতে গোসল করাচ্ছে,আবার কখনো দেখা যেতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের গোসল করার ছলে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপির দৃশ্য। এগুলো দেখতে দেখতে একসময় নৌকা বাজারের ঘাটে পৌঁছে যেতো।এতক্ষণ যা বললাম এগুলো অবশ্য আরো একটু পুরানো কথা। তখন হয়তো আমি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি।

এবার মূল মুল ঘটনায় আসি। একদিন আমি একা সাভার বাজারে যাচ্ছিলাম। আকাশ ছিল বেশ মেঘাচ্ছন্ন। নৌকায় উঠার নির্দিষ্ট ঘাটে এসে দাঁড়ালাম, যেটাকে বলা হয় সড়ক ঘাট। নৌকা ঘাটে আসল, আমি উঠলাম,এর কিছু পরে নৌকা ছেড়ে দিল। অল্প একটু যাওয়ার পরেই বৃষ্টি শুরু হলো.... প্রচন্ড বৃষ্টি। নৌকার উপরে কোন ঝাউনি ছিল না,তাই আমারা ভিজে যাচ্ছিলাম।

মাঝি খুব দ্রুত কাছাকাছি ঘাটে নৌকা থামালো...যেটা একটা প্রাইমারি স্কুল। আমরা (যাত্রী) দৌড়ে স্কুলের এক রুমে প্রবেশ করলাম। যেটাতে ক্লাস হচ্ছিল না। বাইরে তখন রিমঝিম শব্দে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে... সাথে বজ্রপাত। চারদিকে কিছুটা অন্ধকার ভাব, নদীর দিকে তাকালে মনে হয় নদীটা হালকা সাদা কুয়াশায় ঢেকে গেছে।

স্কুলের সামনে ছোট মাঠটিতে এরইমধ্যে এলাকার কিছু ছোট পোলাপান হাফপ্যান্ট পড়ে খালি গায়ে ফুটবল খেলা শুরু করেছে। বৃষ্টির দিনে ফুটবল খেলাটা আসলে একটা ছুতো। বৃষ্টিতে ভিজে মাঠের কাঁদায় গড়াগড়ি করাটাই আসল উদ্দেশ্য। কিছুক্ষণ খেলার পরেই তারা সেই কাঁদা মাখা শরীর নিয়ে সামনের নদীতে গিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করে বাড়িতে ফিরে যাবে।

বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরে হয়তো অনেকেই মায়ের বকুনি খাবে। কেউ কেউ কিছু মাইরও খেতে পারে। কারণ অধিকাংশ সময় পোলাপান বাসায় না বলে লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এবং কাঁদায় গড়াগড়ি করে ফুটবল খেলে। পরে বাসায় গিয়ে বকা খায়, আমিও অনেকবার এরকম করেছি।

আটকে পরা যাত্রীরা কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের মতো করে গল্প করতেছে। তারা হয়তো বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমার তাড়া নেই, চলতে থাকুক না এইরকম মুষলধারে বৃষ্টি ... অন্তহীন সময় ধরে।

আমি জানলার গ্রিলের পাশে বসে অপলক দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছি, কখনো বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতায় পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া দেখছি, কখনো চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনছি,কখনো জানালার গ্রিল দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরছি, কখনো পাশের ক্লাস রুমে থেকে ভেসে আসছে "আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে"... আহ্ কত সুন্দর সময়।

আমি তখন ভাবি..."জীবনটা যদি এখানেই থেমে যেতো, অনন্ত সময়ের জন্য"

কিন্তু জীবন থামে না, জীবন তো থেমে থাকবার নয়। টানা ৪০-৪৫ মিনিট বৃষ্টির পর একসময় বৃষ্টি থেমে গেল। আমারা আবার নৌকায় গিয়ে উঠলাম, নৌকা আমাদের নিয়ে তার গন্তব্যে দিকে চলতে থাকলো।

নোট: এই নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌকা উঠে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। এখন আর কোন ছেলে-মেয়েকে  নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি দেখা যায় না। কোন কৃষক এখন আর তার গরুকে নদীতে গোসল করাতে নিয়ে যায় না।কিছু বড় বড় ট্রলার এখনও চলে, তবে তা হঠাৎ হঠাৎ মাঝ নদীতে আটকে যায়.... নদীর তলদেশে নাব্যতা সংকটের কারণে।

এখান শুশক দেখা যাওয়া তো বহু দূরের কথা, নদী থেকে মাছ'ই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময়ের টলটলে পানির নদী এখন বয়ে নিয়ে যায় কালো কুচকুচে শিল্প কারখানার দূষিত বর্জ্যের পানি।আগে মানুষ যে নদীর ধারে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতো.... এখন তারা সেই নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে নাক চেপে পালানোর চেষ্টা করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.