গাড়ি দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু এবং দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা

গতকাল সারাদেশে ৪৭ জন মানুষ নিহত হয়েছে।এর মধ্যে বনানীতে ২৫ জন, গাড়ি দুর্ঘটনায় ২০ এবং বাকি দুজন খুন হয়েছে। উন্নত বিশ্বে একদিনে ৪৭ জন কেন ২০ জন নিহত হলেও এতোক্ষণে এর দায় নিয়ে কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করে ফেলত।

কিন্তু আমাদের দেশে এই ৪৭ জন নিহত হওয়া কোন বিষয়ই না। কারণ এই দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন করে মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। একদিন না হয় ২৫ জন অতিরিক্ত নিহত হয়েছে,এটা আর এমনকি।এই অতিরিক্ত ২৫ জন আজকে না হলেও কয়েকদিন পর ঠিকই নিহত হতো, হয় গাড়ি দুর্ঘটনায় নতুবা আগুনে পুড়ে।

গত সাড়ে তিন বছরে (২০১৫- জুন ২০১৮ সালে, প্রথম আলো) ২৬,১২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা নিহত হয়েছে।যা গড়ে প্রতিদিন ২০ জন করে।আহত হয়েছে প্রায় ৬২,৪৮২ জন মানুষ। যে দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন করে মানুষ গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হয়, তারপরও সরকার নিশ্চুপ থাকে, সে দেশে কি এগুলো আদৌ দুর্ঘটনা... নাকি হত্যাকান্ড!!

এই দূর্ঘটনা বন্ধে সরকারের জোরালো কোন পদক্ষেপ কি কারো চোখে পড়েছে? আমি অন্তত দেখিনি। এই দুর্ঘটনা গুলোর ৯০ শতাংশই ঘটে গাড়ির বেপরোয়া গতির কারণে। তারপরও কোন ড্রাইভার, হেলপার অথবা গাড়ির মালিকের কি কোন শাস্তি হয়েছে কখনো?... হয় নাই।

সরকারের দৌড় হলো দূর্ঘটনায় ছাত্র নিহত হলে যদি জোরদার আন্দোলন হয় তাহলে দুই একজনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার ব্যবস্থা।এইযে সহায়তা এটা কিন্তু সবাই পায় না। এটা পাবার পূর্বশর্ত হচ্ছে, মরতে হবে ঢাকায়, মৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই ছাত্র হতে এবং এর জন্য জোরালো আন্দোলন করতে হবে।

আবার ছাত্র মারা গেলেই যে আন্দোলন হয় তা কিন্তু না। ছাত্র তো প্রতিদিনই কয়েকজন মারা যায়, কিন্তু আন্দোলন হয় হঠাৎ।তবে ছাত্র মারা গেলেই শুধু আন্দোলন হয়। সাধারণ মানুষ মারা গেলে এ নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলে না।

বেশি বেকায়দায় পড়ে দুই একজনকে আর্থিক সহায়তা দেয়া এটা রাষ্ট্র কর্তৃক সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই না। আর্থিক সহায়তা দিলে সবাইকে দেওয়া উচিত, না দিলে কাউকে না।

গত ১০ বছরে আগুনে পুড়ে মারা গেছে প্রায় ১৬০০ জন মানুষ।২০১৮ সালে দেশে ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২০ হাজার। এই অগ্নিকাণ্ড গুলোর প্রায় ৭০ শতাংশই হয় ঢাকায়।এতো হতাহত,এত ক্ষয়ক্ষতির পরও কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কয়েক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যার রিপোর্ট সাধারণ মানুষ কখনো জানতে পারে না।এই পর্যন্তই দ্বায়িত্ব শেষ, তারপর সেই আগেই মতোই সব চলতে থাকে এবং কয়েকদিন পর পুনরায় কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

প্রায় নিয়মিতভাবেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও দেশের ফায়ার সার্ভিসের কাছে অগ্নি নির্বাপনের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। ৮-১০ বছর আগে সম্ভবত একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগার পর শুনেছিলাম এদেশের ফায়ার সার্ভিসের কাছে নাকি ১২ তলার উপরে উঠার মত মই নেই। ২০১৯ সালে এসে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময়ও শুনলাম এখনো মই দিয়ে ওপরে ওঠার সীমাবদ্ধতা সেই ১২ তলাতেই থেমে আছে।

২০১৪ সালে রাজধানীর শাহজাহানপুরে ৪ বছরের এক শিশু খেলতে গিয়ে পরিত্যক্ত গভীর পাইপে পড়ে গেলে ফায়ার সার্ভিস ২৩ ঘন্টা চেষ্টা করার পরও বাচ্চাটাকে উঠিয়ে আনতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ছিল না। পরে অবশ্য কয়েক তরুণ তাদের উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি দিয়ে বাচ্চাটাকে উঠিয়ে আনে।আল্লাহ না করুক, বর্তমানেও যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটে তাহলে হয়তো শুনতে পারবো ফায়ার সার্ভিসের কাছে এখনো সেই উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নেই।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পরে শুনেছিলাম, ওই ভবনটির অনুমোদন ছিল ৭ তলা পর্যন্ত কিন্তু ভবনটি করা হয়েছিল ৯ তলা পর্যন্ত।গতকাল শুনলাম বনানীতে আগুন লাগা ভবনটির নাকি রাজউকের অনুমোদন ছিল ১৮ তলা পর্যন্ত, কিন্তু মালিক ভবনটি করেছে ২২ তলা পর্যন্ত, মানা হয়নি নকশা।ঢাকার বেশির ভাগ বাড়িই রাজউকের নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মান করা। তাহলে এই ৬ বছরে কী শিক্ষা নিলেন? ভবনের মালিক কি রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে ভবন তৈরি করেছে? রাজউক তখন কোথায় ছিল?

দেশ এভাবেই চলতে থাকে।ঘটনা শেষ.. সেই সাথে এর রেষও শেষ... একই সাথে দ্বায়িত্বশীলদের দায়িত্বও শেষ। আর এভাবেই জন্ম নেয়, রানা প্লাজা.. টঙ্গী... তাজরীন ফ্যাশন... নিমতলী.... চকবাজার কিংবা বনানীর মর্মান্তিক ঘটনা....

স্যাটেলাইট আরো দুইটা আকাশে পাঠান, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় পদ্মা সেতু করেন, আরো দুই তিনটা মেট্রো লাইন করেন... কোন সমস্যা নেই। এগুলো করেন তো আমাদের সাধারন মানুষদের সুবিধার জন্যই। তাহলে এই সুবিধাগুলো ভোগ করার জন্য আমাদের আগে বেঁচে থাকতে দেন।

মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে আধুনিকায়ন করুন। যাতে আমাদের মৃত্যুর সময় তারা নিরূপায় হয়ে তাকিয়ে না থাকে।

বেঁচেই যদি না থাকি তাহলে এই উন্নয়ন দিয়ে কি হবে।তাই দয়া করে আগে আমাদের বেঁচে থাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, তারপর না হয় দেশের উন্নয়ন করলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.