আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই তখন আমাদের এলাকার রাস্তা ছিল কাঁচা, মানে মাটির। তেমন কোন যানবাহন চলাচল করত না, প্যাডেল কিছু রিক্সা চলত তবে ভাড়া ছিল অনেক,তাই সবসময় রিক্সায় যাতায়াত সম্ভব হতো না। আমার এলাকা থেকে সাভারে কলেজে যাওয়ার বেশ কয়েকটি রাস্তা ছিল, তবে তার মধ্যে একটি রাস্তা দিয়ে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করতাম।এই রাস্তা দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবাগান অথবা সালাম বরকত হলের সামনে থেকে রিক্সায় উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইলি ফার্ম গেটে নেমে সেখান থেকে গাড়ি করে সাভার পৌছাতাম।
এই দেড় কিলোমিটার পায়ে হাঁটার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা সবসময় একটা শর্টকাট রাস্তা ব্যবহার করতাম।এই শর্টকাট রাস্তা ব্যবহার করলে ৮-১০ মিনিটের দুরত্ব কমে যেত।এই শর্টকাট রাস্তার মাঝখানে কিছু ধানক্ষেত পড়তো, দুই পাশে ধানক্ষেত তার মাঝে খুব সরু আইল ধরে কিছুটা পথ যেতে হতো।
একদিন এই রাস্তা দিয়ে কলেজে যাচ্ছিলাম, কাঁধে ব্যাগ, পায়ে কালো শু জুতা এবং কলেজ ড্রেস পরে ইন করে। ধান ক্ষেতের আইলের মাঝামাঝি আসার পর দেখি সামনের দিক থেকে দুটি কুকুর দ্রুত গতিতে দৌড়াতে দৌড়াতে এই আইলের দিকে ছুটে আসছে,তারাও এই আইল পার হবে। প্রথমত আমি কুকুর প্রচন্ড ভয় পাই, দ্বিতীয়ত এই সরু আইলে কুকুরকে সাইড দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কুকুর দুটি আইলে উঠলো, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আইল থেকে নেমে ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে থেকে কুকুরদের যেতে দিবো। আমার বাম পাশের জমিতে সদ্য ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে, দেখাই যাচ্ছিল সেখানে অনেক পানি এবং কাঁদা, সুতরাং ওখানে নামার তো প্রশ্নই ওঠে না। ডান পাশের জমিটা আইল থেকে একটু নীচুতে,এর ধানের চারাগুলোও আগে রোপণ করা। জমিতে কোন পানি ছিল না, দেখে মনে হলো মাটিও বেশ শক্ত। কুকুর আসতেছে, আমি আমার ডান পা ধান ক্ষেতে রাখলাম।
আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো,মাটি দেখতে শক্ত মনে হলেও আসলে খুবই নরম এবং কাঁদার পরিমানও ছিল অনেক।পা রাখার সাথে সাথে তা প্রায় আধা হাতের মতো কাঁদায় ঢেবে গেল। আমি শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, সুতরাং বাধ্য হয়ে বাম পা'টাও সেই জমিতে রাখতে হলো এবং সাথে সাথে সেটাও কাঁদায় ঢেবে গেল। আমি এখন পুরোপুরি ধান ক্ষেতে দাঁড়িয়ে আছি এবং আমার পা দুটি জুতাসহ হাঁটু এবং গোড়ালির মাঝামাঝি পর্যন্ত কাঁদায় ঢেবে আছে। কুকুর দুটি দৌড়ে আমাকে অতিক্রম করে আইল পার হয়ে চলে গেল।
আমি আমার বাম পা কাঁদা থেকে উঠিয়ে আইলে রাখলাম। কিন্তু ডান পা উঠছিলো না, কারণ কাঁদা আমার পা শক্ত করে ধরে রেখেছে। একসময় পা উঠলো ঠিকই তবে জুতাটা কাঁদায় আটকে রয়ে গেল। আবার আমি কাঁদায় নেমে হাত দিয়ে জুতা উঠালাম। আমার দুটো জুতা এবং প্যান্টের অনেকটা অংশ কাঁদায় মাখামাখি। শরীরে জিদ চেপে ধরল,কলেজে যাবোই। একটু সামনেই ধান ক্ষেতে পানি দেয়ার জন্য সেচ পাম্প আছে, সেখানে গিয়ে জুতা এবং প্যান্ট ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করলাম।এরপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম কলেজের উদ্দেশ্যে, একটু সামনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আমি হাঁটছিলাম আর আমার প্যান্ট এবং জুতা থেকে পানি চুঁইয়ে রাস্তায় পড়ছিল। হাঁটার সময় জুতা এবং পানির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি হচ্ছিল। আমার অবশ্য এগুলোর দিকে একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই, কারণ আমাকে কলেজে যেতে হবে, শরীরে তখন প্রচন্ড জেদ চেপে আছে।
দয়াকরে কমেন্টে স্পাম মেসেজ দেবেন না।