ইরান রাজনৈতিক কারণে বিশ্বে সবসময় আলোচনায় থাকে।শিয়া অধ্যুষিত মুসলিম এই দেশটি কঠিন ভাবে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে,এই ইসলামী অনুশাসনের মধ্যেও থেকেও তাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় চলচ্চিত্রের একটি বলে মনে করা হয়। তবে ইরানের চলচ্চিত্র অন্য সব দেশের চলচ্চিত্র থেকে পুরোপুরি আলাদা।
তাদের চলচ্চিত্রে থাকে না কোন গ্লামারস,নাচ গান,অথবা প্রেম ভালোবাসা। তাদের চলচ্চিত্রে থাকে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প,যা বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ, মানুষের জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে ইরানি চলচ্চিত্রে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়।যা অন্য দেশের চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখা যায়।
Image Source: https://wondersinthedark.wordpress.com/আজ আপনাদের সাথে এমনই ৬ অসাধারন ইরানী মুভি পরিচয় করিয়ে দিবো। মুভিগুলো যদি ইতিমধ্যেই দেখে থাকেন তাহলে তো খুবই ভালো, আর যদি এখনো না দেখে থাকেন, তাহলে এখনি দেখা শুরু করে দিতে পারেন।এর একটি মুভিও আপনাকে হতাশ করবে না।
6.Bashu, the Little Stranger (1989)
IMDb:8.1
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় বোমা হামলায় ১০-১২ বছর বয়সী এক ছেলের পরিবার এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।সে ভয়ে লুকিয়ে এক ট্রাকে উঠে ইরানের অন্য এক জায়গায় চলে আসে, জায়গাটা কোথায় সেটা সে নিজেও জানে না।সে শুধু জানে তাকে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হবে।ট্রাক থেকে নেমে সে দৌড়ে এসে লুকিয়ে থাকে এক ফসলের মাঠে,এখন থেকে তাকে পায় এক মধ্যবয়সী নারী।ছেলেটি অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা।সে স্থানীয় ভাষা বুঝে না, তার গায়ের রং অন্যদের থেকে অনেক কালো।
সেই ভদ্রমহিলা সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেটিকে তার কাছে রেখে দিবে। কিন্তু বাধা দেয় গ্রামের মানুষ, এমনকি তার স্বামীও।তার স্বামীর যুক্তি হচ্ছে,'পরিবারের আমরা চারজনই ঠিক মতো খেতে পাই না,এই ছেলেটিকে খাওয়াবে কিভাবে!!! কিন্তু ভদ্রমহিলা তার সিদ্ধান্তে অনড়।এক অসহায় অনাথ ছেলেকে আশ্রয় দেয়ার জন্য এই ভদ্র মহিলা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে যে স্টাগল/ পদক্ষেপ নেয় সেটা দেখে সত্যি অবাক
লাগে।
5.The Cow 1969
IMDb:8
ইরানের প্রত্যন্ত গ্রামে কিছু লোক বসবাস করে। তাদের মধ্যে একজনের একটি গাভী রয়েছে, যেটা খুব শীঘ্রই বাচ্চা দিবে। পুরো গ্রামে এই একটিই গাভী। গাভীর মালিক লোকটি বিবাহিত হলেও তার কোন সন্তান নেই। তাই সে গাভীকে তার সন্তানের মত লালন-পালন করে।গোসল করিয়ে দেয়ার সময় সে নিজেও সাথে গোসল করে, তারপর গাভীর শরীর সুন্দর করে মুছে দেয়, সেটাকে খাবার দেওয়ার সময় সে নিজেও কিছু ঘাস খায় এবং রাতে গাভীর পাশেই ঘুমিয়ে থাকে।
গ্রামের সবাই জানে এই ভদ্রলোক খুবই ভালো মানুষ এবং সে তার গাভীকে অত্যান্ত ভালোবাসে। একদিন কোন একটা কাজের প্রয়োজনে সে শহরে চলে যায়... তার শহরে যাওয়ার পরে দিন ই তার গাভীটি মারা যায়। গ্রামের সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়, কারণ লোকটি গ্রামে ফিরে আসলে তারা কি উত্তর দিবে?
লোকটি গ্রামে ফিরে আসলে গ্রামের সবাই তাকে বলে "তোমার গাড়িটি পালিয়ে গেছে"।
কিন্তু সে কি সেটা বিশ্বাস করে!!
এই মুভিটিকে ইরানি মুভি তৈরির পথ প্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
4.Salma and the apple
এই মুভির গল্পটা হচ্ছে সাদেক নামের এক পথিকের।যে একদিন হাঁটতে হাঁটতে এক বাগানে চলে আসে।সেই বাগানের এক আপেল গাছের নিচে সে নামাজ পড়ে। এরপর আপেল গাছ থেকে একটি আপেল তার সামনে পড়লে সেই আপেলটি সাদেক অল্প একটু খায়, তবে আপেলটি খাওয়ার পর সে বুঝতে পারে এই বাগানের মালিককে জিগ্গেস না করে তার আপেল খাওয়া ঠিক হয়নি, এরপর সে বাগানের মালিককে খুঁজতে থাকে।
এই মুভির কলার টোন , সিনেমাটগ্রাফি, বিজিএম ছিল, সবকিছু ছিল খুবই ভালো।এই মুভিতে অনেক কিছু শিখার আছে বিশেষ করে নৈতিক বা সততা।
3.The White Balloon (1995)
Imdb:7.7
মুভিটি ইরানের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প নিয়ে। নববর্ষে ঠিক আগ মুহূর্তে ৭ বছরের রাজিয়া তার মায়ের সাথে বাজারে গিয়ে একটি সুন্দর গোল্ডফিশ পছন্দ করে। যদিও তাদের বাসায় আগে থেকে গোল্ডফিশ রয়েছে, তবে রাজিয়ার ভাষায় সেগুলো অনেক জীর্ণ এবং রোগা। তাই তার নতুন মোটা-তাজা গোল্ডফিশ চাই।যে গুলোর পাখনা অনেক বড়, সাতার কাটলে মনে হয় যেন উড়ছে।
রাজিয়া বাসায় এসে গোল্ডফিশ কেনার জন্য তার মায়ের কাছে ১০০ টাকা চাইতে থাকে। তবে তার মা কোন ভাবেই টাকা দিতে রাজি হয়না। রিজিয়া খুব চিন্তায় পড়ে যায়, কারণ দোকানে আর মাত্র ৪ টি মাছ আছে, তাড়াতাড়ি না গেলে হয়তো সেগুলো ও শেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তার বড় ভাইয়ের সহযোগিতার কারণে তার মা টাকা দিয়ে রাজি হয়।
তার মা একটি ৫০০ টাকার নোট দিয়ে রাজিয়াকে বলে দেয় বাকি ৪০০ টা যেন অবশ্যই ফেরত আনে।
রাজিয়া টাকা পেয়ে খুব খুশি হয়ে দৌড়ে বাজারের দিকে যায় গোল্ডফিশ আনতে।দোকানির সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে সে খেয়াল করে ৫০০ টাকার নোটটি তার সাথে নেই। এরপর সে চারদিকে খুঁজতে শুরু করে।
রাজিয়া নামের এই মেয়েটির অভিনয় এবং কথা শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে। মার কাছে টাকা চাওয়া, না পেয়ে অভিমান করা,আবার টাকা পেয়ে খুশি হওয়া, সেই টাকা হারিয়ে কান্না এবং রাস্তায় এক সৈন্যের সাথে কথা বলার দৃশ্যগুলো হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়।তার কথা, মিষ্টি চেহারা, নিষ্পাপ চাহনি, মুখের এক্সপ্রেশন এইগুলো কখনোই ভুলার নয়।
2. A Separation ( 2011)
IMDb:8.3
সিনেমাটি একটি অস্কার জিতেছে, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, গোল্ডেন বার্লিন বিয়ার, ডারবান আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে সেরা চলচিত্র পুরস্কার সহ ৭৭ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে। তাছাড়াও আরও ৪২ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।
মুভির গল্পটি নাদের এবং সিমিন নামের স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে । তাদের ১৪ বছরের বিবাহিত জীবন এবং তাদের ১১ বছরের একটি মেয়েও রয়েছে । সিমিন তার স্বামী এবং মেয়েকে বিয়ে ভাল জীবন যাপন করার জন্য ইরান ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। কারণ সিমিন চায় না তার মেয়ে এরকম পরিবেশে বেড়ে উঠুক । কিন্তু নাদের তার বাবা যে কিনা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে কিছুতেই রাজি হয় না । নাদের যখন তেহরান ছাড়তে অনিচ্ছুক সিমিন তখন নাদেরকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ডিভোর্স এর আবেদন করে । কিন্তু পারিবারিক আদালত সব কিছু পরীক্ষা করে সিমিনের ডিভোর্সের আবেদন নাকোচ করে দেয়, কারণ আদালত ডিভোর্স দেয়ার পেছনে তেমন কোন কারন খুঁজে পায় না। এভাবেই বিভিন্ন ঘটনা, দুর্ঘটনা এবং মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এই মুভির গল্প এগিয়ে যেতে থাকে।এই মুভিতে পারিবারিক জীবনের কিছু কঠিন বাস্তব চিত্রকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে
1.The Color of Paradise (1999)
IMDb 8.2
এই মুভির গল্প ৮/৯ বছরের মোহাম্মদ নামের একজন প্রতিবন্ধী বালককে।সে জন্মগত ভাবে অন্ধ তবে খুব বুদ্ধিমান। মোহাম্মদের মা নেই,তার বাবা কয়লার খনিতে কাজ করেন। মোহাম্মদ প্রতিবন্ধীদের বোর্ডিং স্কুলে পড়ে যেটা তেহরানে অবস্থিত। মোহাম্মদ অন্ধ এই জন্য মোহাম্মদের বাবা তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তার বাবা ওই গ্রামের এক বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তবে এই বিয়েতে সে মোহাম্মদকে বাঁধা মনে করে।সে ভাবে তার ছেলে অন্ধ এটা মেয়ে পক্ষ জানলে হয়তো তার বিয়ে ভেঙে যাবে।আর এইজন্যই মোহাম্মদ বাবা মোহাম্মদকে দূরে কোথাও রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করে।
পরিচালক মাজেদ মাজেদি এই মুভিতে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বালকের বেদনাদায়ক জীবনকে খুব সুন্দর করে তোলে ধরা হয়েছে। একজন অন্ধ ছেলে, সে জানে তার অন্ধত্বের জন্য কেউ তাকে পছন্দ করে না,সবাই তাকে বোঝা মনে করে, এমনকী তার নিজের পিতাও।তার এই যে অসহায়ত্ব,এটা দেখলে আপনার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে, আপনার চোখ বেয়ে পানি চলে আসবে।
এই মুভির দৃশ্য গুলো এই ছিল অনেক সুন্দর । বিশেষ করে মুহাম্মদের গ্রামটি ছিল ছবির মত সুন্দর.... পাহাড়-ঝরনা, ফুল, নদী,পাখি, প্রজাপতি...... অসাধারণ।
YouTube Video Link: সর্বকালের সেরা ৬ টি ইরানি মুভি, পর্ব-১ । Top 6 Iranian Movie, Part -1
দয়াকরে কমেন্টে স্পাম মেসেজ দেবেন না।