সেরা ৩টি ভিয়েতনামের মুভি

আমার দেখা প্রথম ভিয়েতনামের মুভি ছিল ।মুভিটি আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগেছিলো। কারণ মুভির অনেক দৃশ্যের সাথে আমাদের ছেলে বেলার দিনগুলোর অনেক রয়েছে। এরপর আরো বেশ কয়েকটি ভিয়েতনামের মুভি দেখেছি,তার মধ্যে থেকে তিনটি মুভির কথা আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, বিদেশি ভাষার মুভি দেখতে যদি ভালো লাগে, তাহলে এই তিনটি মুভি আপনি দেখতে পারেন।

সূচীপত্র (toc)'


3.Dreamy Eyes (2019) 

IMDb:7.0

ভিয়েতনামের  নয়ানাভিরাম প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরা এক গ্রাম, যার নাম ডু-ডু। গ্রামের নাম ডুডু,...ডুডু গ্রাম।ডুডু নামের এই ছোট্ট গ্রামে ন্যাং বসবাস করে...যে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করে,মুভির গল্পটা তারই ভালোবাসাকে নিয়ে।

 Image Source:https://e.vnexpress.net/news/life/culture/netflix-to-show-three-vietnamese-movies-4301553.html

তার ভালোবাসার নাম হচ্ছে হা-লান, হা-লান ডুডু গ্রামে নতুন আসে এবং এসে ন্যাঙ এর ক্লাসে ভর্তি হয়।প্রথম দেখাতেই ন্যাঙ হালানকে ভালোবাসে ফেলে, এরপর দিন যায়,মাস যায়, বছর যায়,এর মধ্যে তাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।ন্যাঙ সবরকম পরিস্থিতিতে হালানের পাশে থাকে। কিন্তু কখনোই তার ভালোবাসার কথা হা লানকে বলতে পারে না।

এভাবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখার পর হা-লান সিদ্ধান্ত নেয় সে শহরের স্কুলে গিয়ে ভর্তি হবে।

শহরে যাবার পর হা-লানের চালচলন, জীবন যাপন  সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রথমে এই পরিবর্তন ন্যাং স্বাভাবিকভাবে নিলেও পরে সে বুঝতে পারে, শহরের ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে তার পুরোনো হা-লান। তারপরও ন্যাঙ হালানকে কখনো কিছু বলে না, বরং সবরকম পরিস্থিতিতে তার পাশে থেকে যায়।

রোমান্টিক মুভি হিসেবে এই মুভিটা অসাধারণ ছিল।ন্যাঙ যে হালানকে ভালোবাসে, এই কথাটা সে কখনো হালানকে বলতে পারেনি বা বলার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তারপরেও সে হালানের পাশে থেকে তার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার সেটা দেখে অবাক হয়েছি। যদিও এখানে একটা কথা থেকেই যায়, সেটা হলো, ন্যাঙ এর ত্যাগ স্বীকার করাটা আদৌও যুক্তিসঙ্গত ছিল কিনা।

মুভির সিনেমাটোগ্রাফি,কালার টোন ছিল অসাধারণ সুন্দর।এই মুভিতে ভিয়েতনামের সৌন্দর্য এতোটা সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়েছে যে দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।এই মুভির পরিচালক হচ্ছেন ভিক্টর ভু, উনার মুভিকে আলাদা ভাবে চেনা যায় মুভির দৃষ্টিনন্দন সিনেমাটোগ্রাফি দেখে।


2.Furie (2019)

IMDb:6.3

এই মুভিটা হ্যাই ফুং  নামের একজন সাবেক গ্যাংস্টার নারীকে নিয়ে। তবে এখন সে পরিবার থেকে বিতাড়িত... কারণ তার বাবা যখন জানতে পারে তার মেয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জড়িত তখনই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপর যখন তার মেয়ে জন্ম নেয় তখন সে তার মেয়েকে নিয়ে শহর থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বসবাস করতে থাকে।যাতে করে সব কিছু ছেড়ে সে সাধারণ জীবন যাপন করতে পারে, এবং তার মেয়েকে ভালো ভাবে মানুষ করতে পারে।

                                      Image Source:https://www.netflix.com/bd/title/81075519

কিন্তু ঘটনাক্রমে একদিন সেখান থেকেই তার মেয়েকে শিশু পাচারকারীরা কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়...মেয়েকে খুজতে সে শহরে চলে যায়... সেখানে গিয়ে প্রথমে পুলিশের সাহায্য চাইলেও সেটা কাজে আসে না, এরপর সে নিজেই তার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য বের হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় মুভির ধুমধাম এ্যাকশন।

এই মুভির অ্যাকশন,স্ক্রিনপ্লে,কিছু ডায়লগ,বিজিএম সবকিছু ছিল দুর্দান্ত। মুভিটি খুব ফাস্ট, তাই দেখার সময় ১ ঘন্টা ২৯ মিনিট কিভাবে চলে যাবে আপনি বুঝতেই পারবেন না।

ভিয়েতনামিজ মুভি হলেও এই মুভির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো এশিয়ার অন্যান্য মার্শাল আর্ট অ্যাকশন মুভির থেকে কোন অংশে কম নয়। এই মুভিটা এতো জনপ্রিয় হবার পেছনে এর অ্যাকশন দৃশ্যগুলো একটি প্রধান কারণ।

এছাড়া মুভির কালার টোন, সিনেমাটোগ্রাফি এবং কিছু ড্রোন শট ছিল অসাধারণ সুন্দর....যার মাধ্যমে ভিয়েতনামকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ যদি আগে থেকে না জানে এটা ভিয়েতনামের নামের মুভি, তাহলে দেখার সময় সে ভাববে এটা চাইনিজ অথবা কোরিয়ান অথবা  হলিউডের কোন মুভি।


1.Yellow Flowers on the Green Grass (2015)

IMDb:7.6

ভিয়েতনামের এই মুভিটি দেখতে বসলে মূহুর্তেই আপনি আপনার ছেলে বেলার ফেলে আসা দিন গুলোতে ফিরে যাবেন।নিমিষেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে আপনার ছেলে বেলার স্মৃতিগুলো। কারণ এই মুভির অনেক দৃশ্যের সাথে আমাদের ছেলে বেলার দিনগুলো পুরোপুরি মিলে যায়। 

Image Source: https://www.caseymoviemania.com/2018/08/vff-2018-review-yellow-flowers-on-the-green-grass/


♦️প্লট:

১৯৮০ দশকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ভিয়েতনামের এই মুভিটি একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের দুই ভাইকে কেন্দ্র করে নির্মিত। খুব অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া দুই ভাই থিয়াও এবং তং।বাবা, মা সহ তারা থাকে ভিয়েতনামের পাহাড়ি অঞ্চলে। দুই ভাইয়ের বয়স হবে ১০-১৪ বছরের মধ্যে।তারা দুইজন সারাদিন একসাথে থাকে, কখনো স্কুলে যায়, কখনো বা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়,মাছ ধরে, সবুজ ঘাসে হাঁটে, প্রজাপতির পেছনে ছুটে, কখনো বা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে তাদের সারা দিন কেটে যায়। তারপর রাতে দুই ভাই একসাথে ঘুমিয়ে থাকে,ঘুমের আগে দুজন অনেকক্ষণ গল্প করে।

মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়, কখনও কখনও মারামারিও হয়। তবে ঝগড়া বা মারামারি বেশিরভাগ সময় হয় বড় ভাইয়ের জন্য।ছোট ভাই তং খুব বুদ্ধিমান ও শান্ত এবং সে বই পড়তে খুব ভালোবাসে।

সে তার বড় ভাই থিয়াওকে খুব ভালোবাসে।তং যদি তার বড় ভাই দ্বারা কখনো আঘাত পায় সেটা সে কখনো বাড়িতে এসে বলে না,সে চায় না তার কারণে তার ভাই বাবা মায়ের কাছে বকা খাক।তং এর সাথে তুলনা করলে থিয়াও অনেক স্বার্থপর। বড় ভাই থিয়াও পছন্দ করে তার সাথে একই ক্লাসে পড়া মানকে। কিন্তু সে তার ভালো লাগার কথা মানকে বলতে সহস পায় না।

আর এই জন্য থিয়াও একদিন মানকে চিঠি লিখে।স্কুলের বারান্দায় বসে থিয়াও চিঠিটা লেখা যখন শেষ করে ঠিক তখন হঠাৎ করেই সন চলে আসে। সন আর থিয়াও একই ক্লাসে পড়ে। সন দেখতে বেশ মোটা এবং ক্লাসের সবার চেয়ে বড়। ক্লাসে যারা একটু মোটা হয়, তারা সবসময় তাদের শারীরিক ভাবে শক্তিশালী হবার সুবিধা নেয়। সনের আচরণও ক্লাসের সবার সাথে  ঠিক এমন'ই।সে তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী হবার কারণে সবার উপর কর্তৃত্ব করে,অযথা মাতব্বরি করে,অহেতুক মারামারি করে,তাই সবাই তাকে ভয় পায়।থিয়াও সনকে ভয় পায়।

তো সন  চিঠিটা থিয়াও এর কাছ থেকে টান দিয়ে নিয়ে নেয়। আর বলে তর সব মার্বল‌ আমাকে দিয়ে দে, বিনিময়ে তর চিঠি আমি মানকে পৌঁছে দিবো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও থিয়াও চিঠি আর তার সব মার্বল সনকে দিয়ে দেয়।

সন সেই চিঠি মানকে পৌঁছে দেয় ঠিকই, তবে এমন ভাবে পৌঁছে দেয় যার জন্য থিয়াও ক্লাসে বড় ঝামেলায় পড়ে যায়।এরপর একদিন সন থিয়াওকে স্কুলের পেছনে জোর করে ধরে নিয়ে বলে," থ্রেট দিয়ে বলে তুই আর মানের কাছে যাবি না, ওকে আমি ভালোবাসি।থিয়াও এর প্রতিবাদ করলে,সন থিয়াওকে পিটায়।

বাসায় আসার পর তার ছোট ভাই তং বড় ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে সনকে শায়েস্তা করার বুদ্ধি বের করে। কিন্তু এটা এতো সহজ না, কারণ সন অনেক মোটা আর তাদের থেকে শক্তিশালী। তারপরও তারা দুই সনের বাসায় যায়,ওকে বাড়ির বাইরে ডেকে এনে দুই ভাই মিলে প্রতিশোধ নেয়।

ওহ আরেকটা কথা, ছোট তঙ একটি মেয়েকে পছন্দ করে এবং সেই মেয়ের সাথে সে মাঝে মাঝে কথা বলে। তং তাকে রাজকন্যা বলে। তবে মানুষের কাছে এই রাজকন্যার কোন অস্তিত্ব নেই।

কেউ জানে না রাজকন্যা সত্যি কিনা,সে কোথায় থাকে, কোথায় থেকে আসে, আর কোথায়ই বা চলে যায়। একমাত্র তং তার রাজকন্যার অস্তিত্ব জানে।তং এর রাজকন্যার পরিচয় আমিও গোপন রাখি।তার গোপন কথা গোপনই থাক।

মুভির এক পর্যায়ে এসে মানকে কেন্দ্র করে দুই ভাইয়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়।যেখান থেকে তাদের মধ্যে তৈরি হয় রাগ, অভিমান, হিংসা এবং তারপর বড় রকমের একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায়।এই দূর্ঘটনার কারণে তাদের পরিবারে নেমে আসে অনেক বিপদ। এরপর শুরু হয় তাদের এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃষ্টি, বন্যা। যার ফলে তাদের পরিবার এবং পুরো গ্রামকে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে হয়।

♦️শেষ কথা:

Yellow Flowers on the Green Grass শিশুদের নিয়ে তৈরি করা আমার দেখা সেরা মুভি। মুভিটি দেখার সময় বারবার আপনাকে আপনার ছোট বেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মুভির গল্পটি খুব শক্তিশালী এবং গোছালো আমি তা বলবো না। তবে এর মেকিং অসাধারণ, মেকিংয়ের কারণে গল্পের অগোছালো ভাব চোখে পড়বে না। অভিনয়ের কথা বলতে গেলে,সবার অভিনয় ছিল খুবই ভালো।বিশেষ করে প্রধান তিনটি শিশু চরিত্রের অভিনয় ছিল একেবারেই বাস্তবিক।

এই মুভির পরিচালক ভেক্টর ভুও,এই ভদ্রলোকের আরেকটি মুভি কিছুদিন আগে দেখেছি, (Dreamy Eyes)।এটাও আমার কাছে খুব ই ভালো লেগেছে। উনার মুভির একটা বিশেষত্ব হলো উনি তার মুভিতে ছেলেবেলা, ছেলেবেলা স্মৃতি,গ্রাম, প্রকৃতি, ঐতিহ্য এইগুলো খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে।ভেক্টর ভুও তার তৈরি মুভিতে তার কল্পনার জগতটাকে এমন সুনিপুণ ভাবে উপস্থাপন করে যা আমি খুব কম পরিচালকের মাঝেই দেখেছি।

Yellow Flowers on the Green Grass মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমাটোগ্রাফি এবং কিছু ড্রোন শট এতোটাই দৃষ্টিনন্দন ছিল যে মুভি চলার সময় স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করবে না।এই মুভিতে এতো সুন্দর ভাবে ভিয়েতনামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে যে এই মুভি দেখার পর ভিয়েতনামের নাম দেখলে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে সবুজ দিগন্ত,নির্জন পাহাড়, বয়ে চলা নদী, মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া সবুজ ঘাস,আর তাতে কিছু হলুদ ফুল।

একটি ভালো মুভির স্বার্থকা মনে হয় এখানেই,সে খুব সহজেই আমাদের কল্পনার জগতে প্রবেশ করে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করতে বাধ্য করে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.