Ballad of a Soldier (1959)-Russia

একটি ভালবাসা কিংবা মমতার গল্প
প্রারম্ভিক কথা: Ballad of a Soldier 1959 সালে নির্মিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে একটি রাশিয়ান যুদ্ধের মুভি।ও না, এটাকে শুধুমাত্র যুদ্ধের মুভির কাতারে ফেললে মুভিটির প্রতি অবিচার করা হবে। এটি একই সাথে একটি ভালোবাসার মুভিও বটে। ভালোবাসার মুভি বলতে আমরা যে প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা বুঝি এটা অবশ্য ঠিক তেমন না।

এই মুভিতে যেমন প্রেমিক প্রেমিকার অব্যক্ত ভালোবাসার গল্প আছে, ঠিক তেমনি আছে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় এক অসহায় মায়ের আমৃত্যু পথ চেয়ে থাকার ভালোবাসা কথা। মুভিতে যুদ্ধকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মা-ছেলে এবং এক প্রেমিক প্রেমিকার অব্যক্ত ভালোবাসাকে। মুভিতে দেখানো হয়েছে যুদ্ধ মানুষের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করে হতে পারে। যুদ্ধ মানুষের জীবন থেকে কতো সপ্ন কেড়ে নিয়েছে।

মুভিটি আমি প্রথম দেখেছি ৫-৬ বছর আগে। তখন অবশ্য ফেসবুক গ্রুপগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল না। তখন ব্লগগুলো ছিল খুবই জমজমাট। আর সেই ব্লগ থেকেই মূলত এই ছবিটির সন্ধান আমি পেয়েছিলাম।সব ক্যাটেগরি মিলিয়ে আমি যদি আমার দেখা পৃথিবীর সেরা ১০ টি মুভির নাম বলি, তাহলে প্রথম দিকে থাকবে এই মুভিটির নাম।সারা পৃথিবীতে হাতেগোনা যে কয়টি মুভিকে দশে দশ দেয়া যায় এই মুভিটি হচ্ছে ঐরকম একটি বিরল মুভি।

Warning; পুরো গল্পটা এখানে বলে দেয়া হয়েছে।

গল্প:-১৯ বছর বয়স্ক রুশ সৈন্য আলিয়োশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দুটি জার্মান ট্যাংক ধ্বংস করে।যতটা না সাহসিকতার জন্য তার চেয়ে বেশী আত্মরক্ষার তাগিদে। যাইহোক, তার এই বীরত্বের জন্য তার কমান্ডার জেনারেল তাকে উপাধি দিতে চায়। আলিয়োশা সেই উপাধির পরিবর্তে কয়েক দিনের জন্য ছুটি চায় তার মায়ের সাথে দেখা করার জন্য।কারণ আসার সময় সে তার মায়ের কাছে থেকে ভালো ভাবে বিদায় নিতে পারেনি এবং কিছুদিন আগে তার মায়ের কাছে থেকে প্রাপ্ত একটি চিঠির মাধ্যমে সে জানতে পেরেছে তাদের ঘরের চাল/ছাউনী নষ্ট হয়ে গেছে সুতরাং সেটাও মেরামত করা দরকার। বলে রাখা ভালো আলিয়োশা বাবাও যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

কমান্ডার জেনারেল তার ছয় দিনের ছুটি মঞ্জুর করে।দুদিন যাওয়া, দুদিন আসা এবং দুই দিন তার বাড়িতে থাকার জন্য। যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এরকম ছুটি দেয়া ছিল খুবই বিরল। তাই তার যাওয়ার পথে কয়েকজন সৈনিক তাদের পরিবারের জন্য আলিয়োশার কাছে কিছু সামগ্রী দিয়ে দেয়। সে কথা দেয় সবার সাথে সে দেখা করবে এবং তাদের মালামাল পৌঁছে দিবে।

আলিয়োশা একটি সামরিক ট্রেনে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।সে যে কামরাতে করে যাচ্ছেলো সেটা ছিল পুরোটাই ফাঁকা। কিছুক্ষণ পরে সেই কামরায় লুকিয়ে উঠে পড়ে 'শুরা' নামের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে।(মেয়েটি আসলেই অনেক সুন্দরী। অসাধারণ তার মুখের হাসি।তার মাথার চুল হাঁটু ছুঁই ছুঁই করে। কোন বিদেশী মেয়কে লম্বা চুলে এত সুন্দর দেখাতে পারে এটা  আমি আগে কখনো দেখিনি,এমনকি চিন্তাও করিনি।)

শুরা ওই কামড়াতে উঠার একটু পরে আলিয়োশাকে দেখতে পায় এবং দেখার পর সে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে যেতে চায়। কিন্তু তার দেরি হয়ে গেছে, কারণ ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।ট্রেনে আলিয়োশা যখন মেয়েটির সাথে কথা বলতে তার দিকে যায় তখন মেয়েটি শিশুসুলভ ভাবে ভয়ে খুব জোরে জোরে মা মা করে চিৎকার করে উঠে। অথচ তার সাথে কিন্তু কেউ নেই।এটা খুবই মজার দৃশ্য। একবার তো সে রেগেমেগে আলিয়োশার গালে একটি চড়ও বসিয়ে দেয়।

মেয়েটি একসময় বুঝতে পারে এখান থেকে নামা যাবে না। তাই সে কিছুটা সহজ হতে থাকে। এরপর কথা বলতে বলতে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে উঠে। মেয়েটি আলিয়োশাকে জানায় সে তার বাগদত্তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। যে একজন পাইলট এবং এখন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে।ট্রেন চলতে থাকে, তাদের দুজনের মধ্যে কথাও বাড়তে থাকে এবং একসময় দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
আলিয়োশা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সৈন্যদের দেয়া মালামাল গুলো তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়।এই কাজটি শেষ করার পরে তারা দুজনে একটি স্টেশনে আসে।যে স্টেশনে আলিয়োশা একটি সামরিক বাহিনীর ট্রেন পায়।

আলিয়োশা একটু দেরি করতে চাইলেও শুরা তাকে অনেকটা জোর করেই ট্রেনে উঠিয়ে দিতে চায়। কারণ অলরেডি আলিয়োশা অনেক দেরি করে ফেলেছে।ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে মেয়েটি আলিয়োশাকে জানায় তার আসলে কোন বাগদত্তা নেই এমনকি তার কেউ নেই।সে তার খালার বাসায় যাচ্ছে।সে আসলে ট্রেনে আলিয়োশার ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছিল। আলিয়োশা ট্রেনে উঠতে বাধ্য হয় এবং ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে।মেয়েটি ট্রেনের পিছনে পিছনে ধীরে ধীরে দৌড়াতে থাকে।

আলিয়োশা মেয়েটিকে তার গ্রামের নাম বলে, যাতে মেয়েটি তাকে চিঠি লিখতে পারে কিন্তু ট্রেনের শব্দের কারণে সে কি বলে মেয়েটি সেটা শুনতে পায় না।ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বেড়ে যায় এবং মেয়েটি একসময় দৌড়াতে দৌড়াতে থেমে যায়। ট্রেন চলতে থাকে আর সেই সাথে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্বও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।যে দূরত্ব আর কখনো কোনোকালেই হয়তোবা কমবে না।কারণ তারা দুজন একসাথে দুদিন থাকলেও একে অপরের নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না।

ট্রেন চলে যাওয়ার পর মেয়েটি দীর্ঘক্ষন প্লাটফর্মে একা একা চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। তখন সে মনে মনে বলে "আমি যখন তোমাকে বলেছিলাম আসলে আমার কেউ নেই, তখন আমি তোমাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি সেটা বুঝনি।

ট্রেন কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ করেই ছেলেটির মনে পড়ে মেয়েকে তার কিছু একটা বলার ছিল,যা সে বলতে পারেনি। তার বলার ছিল সে মেয়েটিকে ভালোবাসে। কিন্তু ততক্ষনে সে অনেক দেরি করে ফেলেছে।সে একপর্যায়ে ট্রেন থেকে নেমে যেতে যায় কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব নয়।তারা দুজন যখন আলাদা হয়ে যায় এই দৃশ্যটি আমি কয়েক বার রিপিট করে দেখেছি। তাদের দুজনের মধ্যে ভবিষ্যতে যোগাযোগ করার কোন সুযোগ আছে কিনা সেটা দেখার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই নেই।

ছেলেটি নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক সময় তার গ্রামের বাড়ি পৌছাতে পারে এবং তার মার সাথে দেখাও করতে পারে। কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য,কারণ রাস্তায় তার চারদিন শেষ হয়ে গেছে।আর বাকি দুদিনে তাকে আবার পৌঁছাতে হবে। তার মা কোনোভাবেই ছেলেকে যেতে দিতে রাজি নয়, কিন্তু সত্বেও যেতে দিতে হয়। তবে ছেলেটি যাওয়ার সময় তার মাকে কথা দেয় সে আবার ফেরে আসবে।

🔵এরপর থেকে তার মা ছেলের ফেরার আশায় ঠিক যেখান থেকে ছেলে বিদায় নিয়েছিল সেই দিগন্তজোড়া রাস্তায় এসে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকে। হয়তো কোন একদিন তার ছেলে ফিরে আসবে,এসে তাদের ভেঙে যাওয়া ঘরের ছাদ মেরামত করবে।হয়তো সে ফেরত এসে শুরাকে খোঁজতে যাবে এবং হয়তো পেয়েও যাবে... হয়তো.......

আবার উল্টোটাও হতে পারে... হয়তো ছেলেটা আর  কখনোই ফিরে আসবে না। হয়তো ছেলেটি যুদ্ধের সময় নাম না জানা কোন জায়গায় মৃত্যুবরণ করে।হয়তো হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা সৈন্যদের মতো তার লাশটিও কোন নাম না জানা স্থানে কবর দিবে।হয়তো মেয়েটি ছেলেটির আশায় দিন গুনতে থাকবে এবং এক সময় অন্য এক জায়গায় তার বিয়ে হয়ে যাবে।হয়তো ছেলেটির মা এভাবেই প্রতিদিন তার ছেলের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় আমৃত্যু পথ চেয়ে থাকবে... হয়তো...

মন্তব্য; মুভির তিনটি দৃশ্য মারাত্মক রকম আবেগপ্রবণ এবং অসাধারণ সুন্দর। মুভির শুরুতে যখন এক বৃদ্ধা মা তার একমাত্র ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ছলছল চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে সেই দৃশ্যটি, একে অপরকে ভালোবাসা সত্ত্বেও নিদারুণ বাস্তবতা ছেলে এবং মেয়েটিকে একটি ট্রেনের মাধ্যমে যখন দুদিকে সরিয়ে দেয়। এরপর মেয়েটির প্লাটফর্মে দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে এবং মুভির শেষের দিকে যখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মা তার ছেলেকে কাছে পায় কিন্তু একটু পরেই যখন সেই ছেলেকে আবার সে হারিয়ে ফেলে এই বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলো যে কারও চোখে পানি এনে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

অভিনয়ের কথা বলতে গেলে আলিয়োশা এবং শুরা দুজনের অভিনয় ছিল পুরোপুরি পারফেক্ট। তাদের দুজনের ছেলেমানুষী সুলভ আচার-আচরন,হাসি, কথাবার্তা, চোখের চাহনি ছিল অসাধারণ। যদিও তাদের দু'জনেরই এটি প্রথম মুভি এবং এই মুভি করার সময় তাদের উভয়ের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। যাইহোক বাস্তব জীবনে মেয়েটি ৭১ বছর বয়সে ২০১১ সালে মারা যায়।আর ছেলেটি ৫৫ বছর বয়সে ১৯৯৫ সালে মারা যায়।

যদিও এটি একটি সাদাকালো মুভি তা সত্ত্বেও এই মুভির প্রতিটি দৃশ্যকে আমার শিল্পকর্ম বলে মনে হয়েছে।এর প্রতিটি দৃশ্যকে আমার শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো বলে মনে হয়েছে। ছেলেটির মা যে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে সেই বিস্তীর্ণ রাস্তার দৃশ্য এবং ছেলেটি বিদায় নেওয়ার পর মেয়েটি একা একা যে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে সেই দৃশ্যগুলো ছিল অসাধারণ সুন্দর। মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও মুভির অন্যান্য সকল কিছুর মতোই ছিল খুবই ভালো।

পুনশ্চ:আপনি যদি মুভিটি ৭০ বছরের পুরানো মুভি অথবা সাদাকালো মুভি ভেবে না দেখে থাকেন তাহলে আপনি জিবনে কি মিস করছেন সেটা কখনোই বুঝতে পারবেন না।আপনি যত বড় মুভিখোর'ই হোন না কেন এই মুভিটা যদি আপনি না দেখে থাকেন তাহলে  আপনার মুভি দেখার পূর্ণতা কখনোই পাবে না।এটা আমি দৃঢ় ভাবে বলতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

দয়াকরে কমেন্টে স্পাম মেসেজ দেবেন না।