আমার স্মৃতিমালা-২, নতুন বই এবং আমার ছেলেবেলা

আজকে দেখলাম ছেলে মেয়েদের হাতে বিনা মূল্যে নতুন বই দেয়া শুরু হয়েছে। আমি দাখিল (এস.এস.সি) পর্যন্ত মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি। মাদ্রাসায় তখন বিনামূল্যে বই দেয়া হতো না।তাই পুরনো বই জমা দিয়ে নতুন বই নেয়ার যে উচ্ছাস এবং আগ্রহ সেটা আমি কখনই অনুভব করতে পারিনি।তবে আমার ভাই বোনেরা স্কুলে লেখাপড়া করায় স্কুল থেকে তারা নতুন বই পেত। তাদের নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা এবং সেই বই হাতে পেয়ে খুব খুশি মনে বাসায় ফেরার দৃশ্য এগুলো দেখতে খুব ভালো লাগতো। আমি যেহেতু বিনামূল্যে বই পেতাম না, তাই আমার জন্য আব্বা বই কিনে আনতো। বই কিনতাম অথবা বিনামূল্যে পেতাম তখন উভয় ধরনের বইয়ের মধ্যে একটি জিনিস খুব কমন ছিল, সেটা হচ্ছে নতুন বইয়ের অসাধারণ মাতাল হয়ে যাওয়া ঘ্রান।চোখ বন্ধ করলে এখনো সেই বইয়ের ঘ্রান অনুভব করতে পারি।সেই ঘ্রান যে কত মনমাতানো ছিল সেটা তখন বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারি। তখনকার বেশিরভাগ বই ছিল নিউজ প্রিন্টে প্রিন্ট করা। এজন্যই সম্ভবত ঐ সময়ের বইগুলো থেকে অনেক বেশি ঘ্রান বের হত। আচ্ছা এখনকার বইয়েও কি ঘ্রান পাওয়া যায়! কি জানি, হয়তোবা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ঘ্রান কে খুঁজতে যাবে।এখনকার ছেলেমেয়েদের ঘ্রান(বিনোদন) খুজে পাওয়ার মতো উপকরণের অভাব নেই।তাদের হাতে বইয়ের ঘ্রান খুঁজার সময় কোথায়। নতুন বইয়ের সাথে নতুন খাতাও কিনতাম। নতুন বই হাতে নিয়ে সবার আগে বইয়ে মলাট লাগানোর কথা চিন্তা করতাম। অফিস থেকে আসার সময় আব্বা পঞ্জিকা নিয়ে আসতো।সেই পঞ্জিকা কেটে আমাদের সবার বইয়ে খুব যত্ন করে আব্বা নিজ হাতে বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিত। নতুন বইয়ের সাথে রংবেরঙের নতুন মলাট... আহ্... অপূর্ব সেই দৃশ্য... মাঝে মাঝে নিজেই নিজের চকচকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।প্রাইমারি পর্যন্ত আমাদের সবার বইয়ের মলাটের উপরে আব্বা নিজে আমাদের যার যার নাম, রোল নাম্বার এবং শ্রেণী নং লিখে দিত। একটু বড় হবার পর আমিই সবার বইয়ের উপর নাম লিখে দিতাম।কারন সবাই বলে আমার হাতের লিখা নাকি খুব সুন্দর। তখন বইয়ের মাঝ পৃষ্ঠার দিকে রাখতাম ময়ূরের পাখনা,যেটা আবার কিভাবে যেন বৃদ্ধিও পেত। বিষয়টি খুব অবাক করার, আসলেই কিভাবে ময়ূরের পাখনা বইয়ের মধ্যে থেকে বৃদ্ধি পায়!!অনেকে এগুলো অন্যজনের কাছে বিক্রিও করতো।বই হাতে পাবার পর খুঁজে খুঁজে সবার বই থেকে গল্প গুলো আগে পড়ে শেষ করে ফেলতাম। খুব মজা লাগতো ছোট ছোট গল্প পড়ে। নিজের পড়া পড়তাম আর না পড়তাম খুঁজে খুঁজে গল্পগুলো ঠিকই আগে পড়ে ফেলতাম।বাংলা বইয়ের মধ্যে খুব সুন্দর করে গ্রামীণ চিত্র প্রিন্ট করা থাকত, যেগুলো দেখতেও খুব ভালো লাগতো। তখন বই নিয়ে আরেকটি খুব মজার খেলা খেলতাম।সেটা হচ্ছে এপিঠ ওপিঠ। দু'জন মিলে এটা খেলতাম। বইয়ের একপিঠ থাকত একজনের এবং অন্য পিঠ থাকত আরেকজনের।বইয়ের এপিঠের মালিক তার পিঠে পাওয়া সব মানুষ অথবা অন্যান্য উপকরণের ছবি গননা করে যে কয়টি হতো সেই কয়টি কিল অন্য পিঠ ওয়ালাকে দিত।আবার অন্য পিঠ ওয়ালাও ঠিক একই কাজটি করতো। সবচেয়ে বেশি মার খেতে হত অংক বই নিয়ে খেললে।অংক বইতে লাঠি বা অন্য উপকরণ থাকতো অনেক বেশি আর তাই মাইরও খেতে হতো অনেক বেশি।মাদ্রাসার বইয়ে কোন মানুষের ছবি ছিল না, তাই এই খেলা গুলোর জন্য আমরা স্কুলের বই বেশি ব্যবহার করতাম। এখনকার প্রাইমারি স্কুলের ছেলে মেয়েরা মনে হয় এগুলো আর খেলে না। খেলার অবশ্য কোথাও না। এত এত তথ্য প্রযুক্তির খেলার মধ্যে এই এনালগ খেলা কে খেলতে যাবে!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.