মাদ্রাসায় পড়া এবং আযান দেয়ার স্মৃতি

আমার জন্মের ঠিক কয়েকদিন আগে নাকি আমাদের বাড়ির পাশের মাদ্রাসায় এক বিশাল বড় মাহফিল হয়েছিল। মাহফিলের প্রধান মাওলানার নাম মোঃ লুৎফর রহমান।এরপর যখন আমার জন্ম হলো তখন আমার নানা ঠিক করল ওই মাওলানার নামেই আমার নাম রাখা হবে এবং তাই হলো, আমার নাম রাখা হলো "মোঃ লুৎফর রহমান"।

আমার আম্মা আরো একটু এগিয়ে গিয়ে ঠিক করলো অনেক চাওয়া এবং ত্যাগের পর যেহেতু তাদের একটি সন্তান হয়েছে সুতরাং ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়ে বিরাট বড় মাওলানা করা হবে।তাই হলো, আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়া হলো। আব্বা-আম্মা ভাবলো এবার ছেলে বিশাল বড় এক মাওলানা হবে... ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু এই ছেলে ছোটবেলা থেকেই খুব ভাবুক এবং উদাসী মনের। মন থাকতো পরে বন্ধুদের সাথে রাস্তায়, ফসলের মাঠে, নদীর ধারে.. অথবা কোন খেলাধূলায়। যদিও কখনো যেতে পারতাম না, বাসার নিষেধাজ্ঞার কারণে। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর টিভি দেখতে পছন্দ করতাম, গান এবং রেডিও শুনতে খুব ভালো লাগতো এবং ভালো লাগতো গল্পের বই পড়তে।

আমাদের পাড়ার আমার সমবয়সী অন্য কোন ছেলে তখন লেখাপড়া করতো না। ওদের পালিত গরু নিয়ে ওরা সকালে ফসলের মাঠে যেতো। সারাদিন চকে-মাঠে ঘোরাঘুরি করে বিকেলের দিকে বাসায় ফিরে আসতো।

আর আমি তখন মাদ্রাসার ক্লাস রুমে বসে বসে চিন্তা করতাম আমি কেন ওদের মত হতে পারলাম না। কি মজার একটা জীবন ওদের... আহ্। ওদের সারাদিনের বিভিন্ন মজা করার ঘটনা গুলো সন্ধ্যার দিকে ওদের কাছে থেকে মাঝে মাঝে শুনতাম আর খুব আফসোস করতাম।কতো কিছু জীবনে মিস করতেছি।

ছোটবেলা থেকেই আমি নিরিহ এবং নিপাট একজন ভদ্রলোক ছিলাম। ডানপিঠের বিপরীত যেটাকে বলে আরকি।ছিলাম খুব লাজুক এবং প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেই ছোট থেকেই। মানুষের সাথে খুব কম কথা বলতাম,পরিচিত বা আত্মীয়-স্বজন হলেও কথা বলতাম না, এখনো কম কথা বলি। অনেকে এটাকে অহংকার ভাবে, কিন্তু আমি চাইলেও পারি না। কারণ আমি এই রকমই ... এভাবেই বড় হয়েছি।

এভাবে যখন একটু বড় হলাম মানে ৮ম অথবা ৯ম শ্রেণীতে পড়ি, তখন থেকে আব্বা আম্মা বলতে শুরু করল"মাদ্রাসা গিয়ে কি শিখলি কিছুই তো বুঝি না। যা মসজিদের মাইক দিয়ে একদিন আজান দিয়ে আমাদের একটু শোনা....দেখি কেমন আজান তুই দিতে পারিস"

কি!!আজান দিমু আমি!! তাও মাইকে!! দুজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারিনা,সেই আমি মাইকে আযান দিমু..যা শত শত মানুষ এটা শুনব.... ওরে বাবারে, এটা আমার দিয়ে অসম্ভব। অবশ্য মাইক ছাড়াও আযান দিতে বলছিল, কিন্তু সেটা করতেও আমার সাহসে কুলায়নি।আমাকে দিয়ে মসজিদের মাইকে আজান দেয়ার জন্য টানা কয়েক বছর চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি সাহস পাইনি। আমাকে রাজি করানোর জন্য বিভিন্ন খাবার এমনকি টাকার লোভও দেখিয়েছে ,কিন্তু আমি পারিনি বা আমার সাহসে কুলায়নি।।

শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজের খুতবার আগে যে আযান দিতে হয়, আমাদের মসজিদে অনেক সময় সেই আযান দেয়ার মতো মানুষ থাকতো না। তখন অনেকেই খুঁজতো মাদ্রাসা পড়ুয়া কেউ আছে কিনা.... থাকলে তাকে বলতো আযান দিতে।

দুর্ভাগ্যবশত মাদ্রাসা পড়ুয়া দু-একজন ছিল। ওই সময় আমি ভয়ে থাকতাম, কারণ কখন আমার নাম কেউ বলে ফেলে তার ঠিক নেই।আর তাই আযান দেয়ার সময় হলে আমি চুপিসারে মসজিদের বাইরে চলে যেতাম। কিছু সময় আড়ালে লুকিয়ে থেকে আযান দেয়া শুরু হলে মসজিদে প্রবেশ করতাম।

আবার অনেক সময় নামাজ পড়তে মসজিদে প্রবেশের সময়েই খেয়াল করে দেখতাম নিয়মিত যারা আযান দেয় তাঁরা মসজিদে আছে কিনা.. থাকলে ঐদিন নিশ্চিন্ত থাকতাম..আর না থাকলে আযান দেয়ার আগ মুহূর্তে মসজিদ থেকে বের হয়ে যেতাম এবং কেউ আযান দেয়া শুরু করলে তখন মসজিদে প্রবেশ করতাম।মাঝে মাঝে এটা ভেবে খুব খারাপ লাগে, সাবাই পারে কিন্তু আমি পারি না।আমার সাহস কেন এতো কম!! কেন আমি এতো ভিতু...সবার মতো না!!

‌যাইহোক, আযান একদিন মসজিদে ঠিকই দিয়েছিলাম। একদিন আছর ওয়াক্তে মসজিদে শুধুমাত্র আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধুরা ছিলাম। তখন মনে হয় আমি ক্লাস টেনে পড়ি। হঠাৎ মনে হলো আজকে আযান দিবো। আল্লাহ নাম নিয়ে শুরু করলাম।কিন্তু কিছুটা আযান দেয়ার পর... হঠাৎ আযান ভুলে গেলাম। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন ভাবেই আর মনে করতে পারলাম না। এরপর পিছন থেকে আমার এক বন্ধ এসে বাকী আযান দিয়ে দিছে।

এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ আযান। এরপর আর কখনোই এই সাহস দেখাতে যায়নি। মাওলানাও আর হতে পারিনি।কারণ দাখিল পাশের পর আব্বা আম্মার কিছুটা অমত সত্ত্বেও কলেজে ভর্তি হয়ে যাই...আর এই কারণে এখনো প্রতিনিয়ত বকা খেতে হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.