ঈদ এবং ক্রিকেট খেলা

বেশি না, ৫-৭ বছর আগের কথা।তখন আমাদের ঈদ ছিল পুরোপুরি ক্রিকেট কেন্দ্রিক, সারাদিন মাঠে পড়ে থাকতাম ক্রিকেট খেলা নিয়ে।

তখন ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়ার পরেই ক্রিকেট খেলার জন্য মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম।বাড়ি বাড়ি থেকে পোলাপান খবর দিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করতাম। আমার বাসা থেকে দুই মিনিটের হাঁটার রাস্তার ব্যবধানে মাদ্রাসা এবং স্কুলের বিশাল দুটি মাঠ। এই মাঠেই আমরা ক্রিকেট খেলতাম। বেশিরভাগ সময় স্কুল মাঠে খেললেও অনেক সময় মাদ্রাসার মাঠেও খেলতাম। তবে মাদ্রাসার নিজস্ব হোস্টেল থাকায় সব সময় আমরা সেখানে খেলতে যেতাম না।

ক্রিকেট অবশ্য এমনিও আমরা প্রতিদিন বিকেলে খেলতাম, তবে ঈদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আলাদা কিছু বিশেষত্ব আছে।ওই সময় এমন অনেকেই আছে যারা কখনো ক্রিকেট খেলিনি বা নিয়মিত খেলেনা বা সবসময় বাসায় থাকতে পারেনা, তারাও আমাদের সাথে খেলত...অন্তত ঈদের এই কয়দিনে খেলার মাধ্যমে আমরা সবাই একত্রিত হতাম।


ঈদের দিন থেকে টানা ছয় সাত দিন আমরা সকাল বিকাল ক্রিকেট খেলতাম।সকাল দশটা থেকে শুরু করতাম বারোটা-একটা পর্যন্ত, আবার দুপুর দুইটা-তিনটা দিকে শুরু করতাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। সকালে খেলতাম ২০ ওভার, আর বিকালে ১৫ ওভার।

ঈদের দিন থেকে টানা পাঁচ-ছয় দিন যতবারই খেলতাম প্রায় সব সময়ই বাজি ধরে খেলতাম। কখনো চার লিটার সফট ড্রিংকস, কখনো বা ছয় লিটার কখনো বা তারও বেশি। একবার সর্বোচ্চ ৫০ লিটার বাজি ধরে খেলেছিলাম।

ওই খেলায় আমার দল হেরেছিল, এবং প্রায় পুরো টাকাটাই আমাকেই দিতে হয়েছিল। এভাবে ঈদের মধ্যে যত বছর খেলেছি বাজি ধরে ফেলেছে। তবে সে বাজি শুধুমাত্র সফট ড্রিংকস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকত।

কখনো ১১ জন করে কখনো বা ৯ জন করে দল গঠন করে খেলতাম। আমাদের পাড়া এবং পাশের পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে দুই দল হয়ে যেত। আমাদের পাড়াটা উত্তর-দক্ষিণের লম্বা।বারবার খেলোয়ার বাটোয়ারা করার ঝামেলা মনে হতো, তাই আমরা বেশিরভাগ সময়ই পাড়াকে উত্তর দক্ষিণে ভাগ করে দল গঠন করতাম।

পাড়ার মাঝখানে একটা সীমানা নির্ধারণ করে যারা উত্তর পাশে থাকে তাদের উত্তরের দলে এবং যারা দক্ষিণ পাশে থাকে তাদেরকে দক্ষিণের দলে দিতাম। আমার বাসা পাড়ার দক্ষিণ পাশে, তাই আমি সবসময় দক্ষিণ পাশেই খেলতাম ও সব সময় অধিনায়কত্ব এবং খেলার ব্যবস্থাপনা করতাম। আবার অনেক সময় ছোট-বড় দুই দলে ভাগ হয়েও খেলতাম।মানে পাড়ার ছোটরা ছোট দলে,আর বড়রা বড় দলে।

২০ টাকার টেনিস বলের মধ্যে ১৫ টাকার ওসাকা কসটেপ পেঁচিয়ে বল তৈরি করে সেই বল দিয়ে খেলতাম। আমি বলে কসটেপ পেচাতে পারতাম না, এখনো পারি না।তবে অনেকেই আছে খুব সুন্দর করে টেনিস বলে টেপ পেচায়।

মাঠের আশপাশে অনেক ধান ক্ষেত এবং জঙ্গল ছিল, তাই অনেক সময় বল হারিয়ে যেত।আবার অনেক সময় আশপাশের ডুবা-নালার পানিতে বল পড়ে যেত। পানিতে পড়লে বলের কসটেপ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য আমরা বল তৈরি করতাম কয়েকটি, যাতে হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেলও খেলায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে।বলে কসটেপ আমরা দোকান থেকে বাকিতে কিনে আনতাম।

নিয়ম ছিল যে দল হারবে সেই দল দোকানের বল এবং কসটেপের দাম পরিশোধ করবে। বল কোথায় যায় সেটা দেখার জন্য পাড়ার ছোট পোলাপানদের রাস্তায় অথবা টিনের চালের উপর বা ছাদের উপর বসিয়ে রাখতাম।

অনেক সময় বল যখন ধানক্ষেত অথবা অন্য কোন ফসলের জমিতে হারিয়ে যেত, তখন আমরা ১০-১২ জন একসাথে গিয়ে বল খুঁজতাম। এইগুলো দেখে জমির মালিক বকাঝকা করত। তবে বেশি কিছু বলতে পারত না, কারণ সে আবার পরে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় পেত।

খেলা শুরু হওয়ার আগেই টস দেয়া নিয়ে মাঝে মধ্যে গন্ডগোল লেগে যেত। বেশিরভাগ সময় কোন অজ্ঞাত কারণে আমাদের সাথে কয়েন থাকতো না। তাই আমরা খেলার আগে টস দিতাম গাছের ছোট পাতা বা বড় পাতার অল্প অংশ ছিঁড়ে সেটা দিয়ে। দুই দলের অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নিত গাছের পাতার কে কোন পিঠ নিবে।

তারা বলার পর সেই পাতা হাতের আঙ্গুলের মধ্যে নিয়ে ফু দিয়ে উপর দিকে উড়িয়ে দিতাম, সেটা ঘুরতে ঘুরতে নিচে ঘাসের উপর পড়লে যে পিঠ উপরে থাকবে সেই টসে জিতবে।এই হাতে ধরা, ফু দেয়া এবং সেটা নীচে বিভ্রান্তকর অবস্থায় পড়া নিয়ে ঝগড়া লেগে যেত... একপক্ষ মানতো না।অনেক সময় অপর পক্ষকে মানাতে এই ভাবে তিনবার টস দিতে হতো।

খেলা শুরু হতো... সাথে সাথে বিভিন্ন সমস্যাও শুরু হতো।বেশিরভাগ সময় ঝামেলা হতো আম্পিয়ার নিয়ে। কারণ নিরপেক্ষ আম্পিয়ার সহজে পাওয়া যেত না... রোদ্রের মধ্যে এতক্ষণ কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে চায়তো না। তাই দুজন অ্যাম্পিয়ারই সব সময় ব্যাটিং দলের থাকতো।মানে যে দল ব্যাট করবে সেই দলের আম্পিয়ার থাকবে।

এই দলীয় আম্পিয়ার প্রায়ই শুধু শুধুই ওয়াইড এবং নো-বল দিত।ওয়াইড এর সীমানা দিতাম ব্যাট দিয়ে মেপে জুতা দিয়ে। বল জুতার উপর দিয়ে যাওয়া না যাওয়া বা জুতা আস্তে করে সরিয়ে দেয়া এগুলো নিয়ে শুরু হতো ঝামেলা।

অ্যাম্পিয়ার ওয়াইড, নো বল সহজে দিলেও কিছু আউট খুব সহজে দিতে চাইত না।এর মধ্যে একটি হচ্ছে রান আউট, অপর একটি হচ্ছে খুব অল্প শব্দে কিপিং এর কাছে ক্যাঁচ এবং এরপর এলবিডব্লিউ। অবশ্য বিতর্ক এড়াতে এলবিডব্লিউর আউট দেয়া একরকম নিষিদ্ধ ছিল।

প্রথম দলের অ্যাম্পিয়ারের আচরণ দেখে দ্বিতীয় দলের আম্পিয়ারও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিত।প্রথম দলের অ্যাম্পিয়ার তার দলের জন্য যতটা টানতো দ্বিতীয় দলের আম্পিয়ার পারলে তার থেকে বেশি টানতো। এই রকম টানাটানি এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণে খেলার মাঝামাঝি এসে ঝগড়া লেগে যেতো। খেলা অনেকক্ষণ বন্ধও থাকতো, কারণ এক পক্ষ রাগ করে না খেলে চলে যেতে চায়তো।

আরেকটি সমস্যা হতো খাতায় রান কাটা নিয়ে। নিরপেক্ষ কাউকে না পাওয়া গেলে রান কাটার খাতা সবসময় থাকতো ব্যাটিং দলের কাছে। ব্যাটিং দল অনেক সময় রান বেশি কেটে চুরি করার চেষ্টা করত। অবশ্য বোলিং দল কখনই ব্যাটিং দলকে বিশ্বাস করত না। তাই তারা নিজেরাই মুখে মুখে এবং জোরে জোরে রান গননা করত। যাতে ব্যাটিং দল রান চুরি করতে না পারে।

খেলার এইসব ঝামেলা এবং ঝগড়া গিয়ে পরত বাজির এর উপর। অনেক সময় খেলা শেষ হওয়ার পর দুর্নীতির অভিযোগ এনে জয়ী দলকে তাদের প্রাপ্য সফট ড্রিংকস পরাজিত দল সহজে দিতে চাইত না। একবার আমার দল জেতার পর ৮ লিটার সেভেন আপ পরাজিত দল দিতে বারবার অস্বীকার করায় আমি মাঠের মধ্যেই নতুন কিনা একটি ব্যাট আছড়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। এরপর অবশ্য খেলা কয়েকদিন বন্ধ ছিল।

 আবার অনেক সময় খেলার মধ্যে এতটাই উত্তেজনা এবং বিরোধ তৈরি হতো যে, জয়ী দল সেভেন আপ নিয়ে সেখান থেকে সৌজন্যতা রক্ষার জন্য ২-১ লিটার পরাজিত দলকে দিলেও পরাজিত দল সেটা লজ্জায় নিতো না।পরাজিত দলের সবাই মিলে সফট ড্রিংকসের টাকা পরিশোধ করতে হত। তবে যাদের টাকার সমস্যা থাকতো তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো না এবং সিনিয়রদের বেশি টাকা দিতে হতো।

এতক্ষন আমি যা বললাম তার সবই খারাপ দিক। খারাপ দিকটা খুব সুন্দর ভাবে বর্ননা করে লিখা যায় কিন্তু খেলার মূহুর্তের যে ভালো লাগা বা সুন্দর মূহুর্ত তা কখনোই শব্দ দিয়ে বর্ননা করা যাবে। তবে আমার কাছে ওই উল্লেখিত খারাপ দিক গুলোই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো লাগার মূহুর্ত।যা কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়।

আমি এতক্ষণ যে কথাগুলো লিখলাম তার সবই অতীতকালে। কারণ হলো এইভাবে খেলা এবং পুরো খেলাধুলা আরো ৫-৬ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।খেলাধুলা সেদিনই বন্ধ হয়েছে, যেদিন ভবিষ্যৎ কিশোর প্রজন্মকে নৈতিকভাবে শিক্ষিত না করে সবার হাতে হাতে মোবাইল এবং থ্রিজি-ফোরজি চালু করে দেয়া হয়েছে, 

খেলাধুলা সেদিনই বন্ধ হয়ে গেছে যে দিন থেকে বাফারিং ছাড়া নীল সাগরে খুব সহজেই হাবুডুবু করা যায়, খেলাধুলা সেদিনই বন্ধ হয়ে গেছে যেদিন থেকে প্রেম হয়ে গেছে সহজলভ্য আর প্রেম মানে হয়ে গেছে শারীরিক সম্পর্ক,খেলাধুলা সেদিনই বন্ধ হয়ে গেছে যে দিন থেকে সিগারেট তো যেমন-তেমন হাত বাড়ালে এর থেকে ভয়ানক মাদক পাওয়া যায়।

এখন ২২ জন তো দূরের কথা, খেলার জন্য ৯ জনও খুঁজে পাওয়া যায় না, অথচ এখন ৪ টিম গঠন করে খেলার মত পোলাপান এলাকায় আছে।বিশাল বিশাল দুইটা মাঠ পরিত্যক্ত পড়ে থাকে কিন্তু খেলার কেউ নেই, সেই মাঠে এখন গরু-ছাগল চরে। আর গরু-ছাগল যেখানে থাকার কথা সেই ফসলের মাঠে, রাস্তাঘাটে, চিপায়, পাড়ার আশপাশে পড়ে থাকে পোলাপান। তাদের খেলার সময় নেই..তারা এখন ব্যস্ত... তবে অন্য কিছু নিয়ে

তারা এখন পর্ন দেখা নিয়ে ব্যস্ত...মোবাইলে গেম খেলা নিয়ে ব্যস্ত.... ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করা নিয়ে ব্যস্ত.... তারা এখন নেশা করা নিয়ে ব্যস্ত এবং পরবর্তী নেশার টাকা কিভাবে আসবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত... তারা এখন প্রেমিকাকে একটু খানি দেখার জন্য প্রেমিকার বাড়ির আশপাশে ঘুরাঘুরি নিয়ে ব্যস্ত এবং রাতে কিভাবে প্রেমিকার সাথে দেখা করা যায় সেই রাস্তা বের করা নিয়ে ব্যস্ত। এত এত ব্যস্ততার মধ্যে কষ্ট করে কে খেলতে যাবে!!

এই মোবাইল+ইন্টারনেট+পর্নো+প্রেম+ মাদক  এই বিষয় গুলো একটির সাথে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এগুলোই হচ্ছে বর্তমান কিশোরদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয় হয়েছে তার জন্য দায়ী। অন্য এলাকার কি অবস্থা আমি জানিনা, তবে আমার এলাকার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ।

গত কয়েকবছরে স্কুল পড়ুয়া ডজন ডজন ভালো ছেলেকে আমি খারাপ হতে দেখেছি। কিন্তু কিছুই করার বা বলার নেই। কারণ এই স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় প্রশ্রয় পায়। যার কারনে তারা মাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ অনায়াসে করে থাকে।

আমরা যখন কিশোর ছিলাম এবং সবাই মিলে যখন একসাথে খেলাধুলা করতাম তখন আমাদের সবার মধ্যে অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিল। সবাই একসাথে থাকতাম, ঝগড়া হতো খুব কম, মারামারি তো প্রশ্নই উঠে না। ছোটরা বড়দের সম্মান করতো, তাদের কথামত চলতো, বড়রাও ছোটদের স্নেহ করতো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পুরোই উল্টো হয়ে গেছে....এই পরিস্থিতির পরিবর্তন কিন্তু খুব বেশি দিনের ব্যবধানে হয়নি... মাত্র ৬-৭ বছরের ব্যবধানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.