অপূর্ণ ভালোবাসার গল্প...

কিছু কিছু মুভিতে এমন কিছু ভালোবাসার আছে যা একবার দেখলেই হৃদয়ে গেঁথে থাকে। যদিও চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কিন্তু তারপরও বাস্তবের সাথে এদের মিলাতে খুব ইচ্ছে করে,মনে হয় এইগুলো বাস্তবে হলে কেমন হতো?

তিনটি মুভি থেকে এইরকমই  তিনটি অপূর্ণ ভালোবাসার গল্প এখানে বলার চেষ্টা করলাম;

সূচীপত্র (toc)

💧Fury (2014)

Fury মুভির এমা আর নরম্যানে কথা মনে পড়ে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নির্মিত Fury মুভির একটি দৃশ্যে দেখা যায়,"গল্পের মুল অভিনেতা ব্যাড পিট তার সহযোগী নরম্যানকে নিয়ে তাদের দখলকৃত জার্মানির একটি শহরের এক বাড়িতে প্রবেশ করে।ওই বাড়িতে তখন মধ্য বয়সী এক নারী এবং তার ভাতিজি এমা নামের এক মেয়ে উপস্থিত ছিলো।এমা অসম্ভব রকমের সুন্দরী একজন মেয়ে...তার সুনালী চুল আর সাগরের জলরাশির মতো নীল চোখের দিকে তাকালে‌ যেকেউ তার প্রেমে পরতে বাধ্য।

ওই দুই নারী ব্যাড পিট এবং নরম্যানে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। ব্যাড পিট ন্যরমানকে বলে, "তুই মেয়েটাকে নিয়ে অন্য রুমে না গেলে আমিই নিয়ে যাবো।" তবে নরম্যান যেতে চায় না।নরম্যান বয়সে অনেক তরুণ এবং বিবেকবান একজন মানুষ।এমা যখন বুঝতে পারে তাকে আজকে ধর্ষণ হতেই হবে,তখন সে নিজে থেকেই নরম্যানকে নিয়ে পাশের রুমে চলে যায়। 

তারা অন্য রুমে গিয়ে তেমন কিছু করে না। তবে নরম্যান খুব মনোযোগ দিয়ে এমার হাত দেখে,এটা নাকি সে তার দাদির কাছে থেকে শিখেছে। সে ভবিষ্যৎ বাণী করে এমাকে বলে,"শিগগিরই সে তার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পাবে।"এমা অবশ্য নরম্যানের কথার কিছুই বুঝে না। কারণ নরম্যান কথা বলছে ইংরেজিতে,আর এমা ইংরেজি বুঝে না।তবে এমা এটা বুঝতে পারে যে নরম্যান একজন ভালো মানুষ, অন্য সৈন্যদের মতো হিংস্র জানোয়ার না।

ওই বিল্ডিং এ অল্প  কিছুক্ষণ থাকার পর হঠাৎ করেই নরম্যানদের চলে যাওয়ার সময় হয়। তখন এমা বলে, "তুমি পড়তে জানো? আমি তোমাকে চিঠি লিখবো।" এর থেকে বেশী কিছু বলার সুযোগ তারা পায়না,তার আগেই নরম্যানকে চলে যেতে হয়।

নরম্যান যখন ওই বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসে ঠিক তার পরপরই ওই বিল্ডিং এ একটি বোমা এসে পরে।নরম্যান বোমা থেকে বাঁচতে ট্যাংকের নিচে গিয়ে লুকায়,যখন সে চোখ খুলে তখন সে দেখে সামনের যে বিল্ডিং এ এমার সাথে এতোক্ষণ কথা হয়েছিল, সেই বিল্ডিংটি বোমার আঘাতে এখন মাটির সাথে মিশে গেছে।

সে দৌড়ে বিল্ডিং এর কাছে গিয়ে দেখে ১ মিনিট আগে যে এমার সাথে কথা হলো, চোখাচোখি হলো,হাত দেখলো, যে এমা থাকে চিঠি দিবে বলেছিল, সেই এমার নিথর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখন ইটের নীচে চাপা পরে আছে।নরম্যান পাগলের মতো চিৎকার করে তার কাছে ছুটে যেতে যায়, কিন্তু পারে না।

নরম্যানকে তার সহযোগী সৈন্যরা এসে জোর করে ধরে নিয়ে যায়, কারণ তাদেরকে যুদ্ধে করতে আরেক শহরে যেতে হবে।ট্যাংক নিয়ে নরম্যান চলে যায়, পেছনে ইটের নীচে চাপা পরে থাকে এমার মৃত দেহ। এমা কিন্তু নরম্যানের ভবিষ্যত বাণীর কথা মতো তার ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিকই খুঁজে পেয়েছিল,তবে সেটা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। 

আচ্ছা,এমা যদি না মরা যেতো, তাহলে কি হতো? যুদ্ধ শেষ হতো, নিশ্চয়ই এমা আর নরম্যান একেঅপরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো, হয়তো পারতো ,হয়তো পারতো না।

💧Christmas in August (1998) South Korea

দক্ষিণ কোরিয়ার এই রোমান্টিক মুভিটি একজন ফটোগ্রাফার এবং একজন পার্কিং এজেন্টকে নিয়ে।এজেন্ট Da-rim একদিন Jung এর স্টুডিওতে আসে কিছু ছবি প্রিন্ট করতে। এভাবে কাজের প্রয়োজনে আসতে আসতে একসময় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং সেখান থেকে ভালোবাসা। তবে তাদের ভালোবাসা অপ্রকাশিতই থেকে যায়।Jung যখন বুঝতে পারে Da-rim তাকে ভালোবাসে তখন সে তার স্টুডিওতে বন্ধ করে দেয়।কারণ Jung মরণঘাতি রোগে আক্রান্ত,তার আয়ু বড়জোর আর কয়েক মাস।তাই সে চায় না মাত্র অল্প কিছুদিনের জন্য Da-rim কষ্ট পাক,তাই Jung আড়ালেই থেকে যায়।

Da-rim এর কাছে স্টুডিও ঠিকানা ছাড়া Jung কে পাওয়ার জন্য আরো ঠিকানা জানা ছিল না।সে প্রতিদিন স্টুডিও এর সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে,একদিন একটি চিঠি রেখে দেয়, কয়েকদিন পর এসে দেখে সেই চিঠি সেখানেই রয়ে গেছে। একদিন এসে রাগে ঢিল ছুড়ে স্টুডিও কাচ ভেঙে ফেলে।

Jung একদিন এক কফিশপে আসে।যে কফিশপে থেকে Da-rim কে দেখা যায়।কাচ দিয়ে ঘেরা কফিশপে বসে সে দূর থেকে Da-rim কে দেখে।তাদের দুজনের মাঝে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল।Jung সেই স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালে হাত বুলিয়ে Da-rim এর শরীরে হাত রাখে।

অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা Da-rim কখনো জানবেও না যে লোকটির জন্য সে প্রতিদিন অপেক্ষা করে সে এখন অল্প দূরে কাচে হাত রেখে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে,সে হয়তো কখনো জানতেও পারবে না আসলে Jung  তাকে অনেক ভালোবাসতো, কিন্তু নির্মম বাস্তবতা তাকে সামনে আসতে দেয় না, কখনো দিবেও না।

Da-rim হয়তো এভাবেই মাঝে মাঝে এসে স্টুডিও এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে,হয়তো কোন একদিন জানবে Jung আর বেঁচে নেই,হয়তো কখনো জানবে না।


💧Ballad of a Soldier (1959) Russia

যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য আলিয়োশাকে ছয় দিনের ছুটি দেয়া হয়।চারদিন আসা যাওয়া,বাকি দুইদিন তার মায়ের কাছে থাকার জন্য।যাওয়ার পথে কয়েকজন সৈন্য আলিয়োশাকে কিছু জিনিস দেয় তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য।সে সেইগুলো নিয়ে একটি ট্রেনে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিছু পরে সেই ট্রেনের ফাকা কামরায় লুকিয়ে উঠে পরে শুরা নামের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে।

মেয়েটি আসলেই অনেক সুন্দরী। অসাধারণ তার মুখের হাসি।তার মাথার চুল হাঁটু ছুঁই ছুঁই করে। কোন বিদেশী মেয়কে লম্বা চুলে এত সুন্দর দেখাতে পারে এটা  আমি আগে কখনো দেখিনি,এমনকি চিন্তাও করিনি।


তো,তাদের দুজনের মধ্যে প্রথমে ঝগড়া হয়।আলিয়োশা শুরার সাথে কথা বলতে গেলে মেয়েটি বাচ্চাদের মতো মা মা বলে চিৎকার করে উঠে, এবং এক পর্যায়ে সে আলিয়োশাকে একটি থাপ্পরও দেয়।এক সময় তাদের মাঝে মিটমাট হয়ে যায়।তারা দুজন একসাথে সেই সৈন্যদের দেয়া জিনিসগুলো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেয়।এভাবে চারদিন সময় চলে যায়।আলিয়োশাকে এখন বাড়িতে যেতেই হবে,না হলে সময় মতো ফিরতে পারবে না।

তারা একটা রেল স্টেশনে আসে,আলিয়োশা একটি প্রায় চলন্ত সামরিক ট্রেন পায় এবংঅনেক ভীড় ঠেলে সে ট্রেনে উঠে।ট্রেন চলতে থাকে... মেয়েটিও পেছনে পেছনে আসতে থাকে।আলিয়োশা চিৎকার করে তার গ্রামের ঠিকানা বলে যাতে শুরা তাকে চিঠি লিখতে পারে।তারা চারদিন একসাথে কাটালেও একে অপরের নাম ছাড়া আর কিছুই বলা হয়নি।

ট্রেনের শব্দে আলিয়োশার কথা শুরা বুঝতে পারে না।সে ট্রেনের পেছনে পেছনে দৌড়ায়,আলিয়োশা তাকে চিৎকার করে কি যেন বলার চেষ্টা করে কিন্তু মেয়েটি কিছুই শুনতে পায় না। ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বেড়ে যায় এবং মেয়েটি একসময় দৌড়াতে দৌড়াতে থেমে যায়। ট্রেন চলতে থাকে আর সেই সাথে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্বও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।যে দূরত্ব আর কখনো কোনোকালেই হয়তোবা কমবে না।

শুরা দীর্ঘক্ষন চুপচাপ স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।শুরার আসলে কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই,যুদ্ধ তার সব কেড়ে নিয়েছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে সে মনে মনে বলে,"আমি যখন তোমাকে বলেছিলাম আসলে আমার কেউ নেই, তখন আমি তোমাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি সেটা বুঝনি।"

চলন্ত ট্রেনে আলিয়োশার হঠাৎ খেয়াল হয় সে কিছু একটা ফেলে এসেছে,শুরাকে তার কিছু বলার ছিল যেটা সে বলতে পারেনি।তার বলার ছিল সে শুরাকে ভালোবাসে।সে ট্রেন থেকে নামতে চায়, কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব না।

তাদের দুজনের হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তবুও হয়তো শুরা আলিয়োশার জন্যঅপেক্ষায় থাকবে,সে হয়তো মনে করবে আলিয়োশা তাকে কোন একদিন খুজে বের করবে। আবার এমনও হতে পারে, এরপরের বার যুদ্ধে গিয়ে আলিয়োশা আর বেচে ফিরবে না। তবুও হয়তো শুরা আলিয়োশার জন্য অপেক্ষা করবে। আবার এমনও হতে পারে যুদ্ধ শেষে আলিয়োশ সেই স্টেশনে এসে শুরাকে খুজতে থাকবে, কিন্তু শুরা কি তখন বেঁচে থাকবে? তার তো কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

💧নরম্যান-এমা,Darim - Jung,আলিয়োশা-শুরা চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও অনেকটা বাস্তবের মতোই।যুদ্ধ নিশ্চয়ই তাদের মতো অনেক ভালোবাসাকে কেড়ে নিয়েছে।আর বাস্তবতাও‌ Darim-Jung এর চরিত্রের মতো অনেক ভালোবাসাকে দূরে সড়িয়ে দেয়। বাস্তবতার কারণে Jung এর মতো হয়তো অনেককে দূরে সরে যেতে হয়।ভালোবাসায় অনেক সময় প্রিয় মানুষটিকে দূরে ঠেলে দিতে হয়,এতে যদি তার ভালো নিহিত থাকে তাহলে তাকে হারানোর কষ্টটা মেনে নেয়া তেমন কষ্টের মনে হয় না।তবুও তুমি ভালো থেকো...ভালো থেকো ভালোবাসা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.