মুসলমানি করার স্মৃতি

 এলাকার এক ছেলের আজকে সুন্নাতে খাতনা বা মুসলমানি করা হলো। আমার ছোটবেলার মুসলমানি করার স্মৃতিটা একটু বলি,মনে পড়লো আজকে।এখন অধিকাংশ ছেলেদের মুসলমানি করা হয় হাসপাতালে নিয়ে, কিন্তু আমাদের সময়ে হাসপাতালে নেয়া হতো না।তখন আমাদের এলাকায় দুইজন লোক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এই কাজ করতো।এইকাজটা শীতের সময়ে বেশি করা হতো, কারণ শীতের সময়ে নাকি বেশি শুকায়!😒


তো,সেই দুইজন লোক যারা মুসলমানি করাতো তাদেরকে আমরা স্থানীয় ভাষায় "হাজাম" বলতাম। তাদের মধ্যে একজন ছিল বেশ ভদ্রলোক টাইপের। তিনি সব সময় পরিপাটি প্যান্ট-শার্ট,জুতা পরতো এবং হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিতে যাতায়াত করতো।আমরা তাকে ডাক্তার বলে ডাকতাম, যদিও সে ডাক্তার না। 


অন্যজন ছিল এই ডাক্তারের পুরোপুরি বিপরীত চরিত্রের।সে সময় সাদা জামা কাপড় পরতো, দেখতেও বেশ কালো,চুল আর গোফ বড় বড়, মানে দেখেই ভয় পাওয়ার মতো চরিত্র। উনি একটি ফনিক্স সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। তার সাইকেলে একটি ব্যাগ বাঁধা থাকতো, সেই ব্যাগে তার মুসলমানি করার যন্ত্র রাখা হতো।


আমরা প্রথম জনকে মোটেও ভয় পেতাম না, কিন্তু দ্বিতীয় জনকে দেখে বা তার কথা শুনলেই প্রচন্ড ভয় পেতাম।এমনও অনেক হয়েছে, আমরা মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলছি, ঠিক সেই সময় যদি কেউ বলতো,"এই হাজাম আসতেছে"। আমরা খেলাধুলা বাদ দিয়ে দৌড়ে একেকজন এদিক সেদিক পালিয়ে যেতাম।আর খেলার মাঠে থেকেও ধরে নিয়ে মুসলমানি করিয়ে দেয়া হয়েছে,এমন ঘটনা তো অনেক আছে। সুতরাং ওই ভয়টা সবসময় মনের মধ্যে থাকতো।


মুসলমানি করতে অপরজনের চেয়ে ডাক্তারের চার্জ ছিল বেশী।এই কারণে ডাক্তার কাজ পেতো কম।তবে ডাক্তারের মুসলমানি করানোর পদ্ধতি অপর হাজামের চেয়ে অনেক অনেক বেশি মানবিক আর স্বাস্থ্য সম্মত ছিল। 


কাউকে মুসলমানি করা হবে এটা জানলে আমরা দলবল নিয়ে সেই বাড়িতে উপস্থিত হতাম। তবে ভয়ে মুসলমানি করার স্পটে যেতাম না, আশপাশ থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখম।সেই ভয়ংকর কালো হাজাম লোকটা মুসলমানি করানোর আগে ছন্দের মতো কি যেন বলে নিতো, এইগুলো বলে সে মুসলমানি করানো ছেলেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতো। এরপর হঠাৎ করেই কেটে ফেলতো... তারপর সেই ছেলেটার কষ্টের কান্না।


এদিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের বুকের ভেতরটা তখন ভয়ে ধড়ফড় করে কাঁপত, কারণ খুব শিগগিরই একদিন আমাদেরও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।


সেই ভয়ংকর কালো সময় একদিন আমাদের বাড়িতেও আসলো। বিকালের দিকে খেলার মাঠ থেকে আমাদের দুই ভাইকে ডেকে আনা হলো...দুইজনকে একাসাথে মুসলমানি করা হবে।এসে দেখি বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ, ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা আরো বাড়তে থাকলো, ভয়ে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেলো.... কারণ বুঝতে পারছিলাম এখন কি হবে।


আমাদের নতুন লুঙ্গি পারানো হলো। দুয়ারে সজনে গাছের নিচে তাল পাতার পাটি বিছানো হলো, সেখানে সেই ডাক্তার হাজাম সহ আরো কিছু মুরুব্বি বসলো, আমাকে একটি উঁচু পিড়িতে বসানো হলো।হাজাম তার ব্যাগ থেকে একে একে মুসলমানি করানোর  যন্ত্র বের করল, আমি তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম।আর তখন আমি ভয়ে মরে যাই যাই অবস্থা। চারপাশে তখন অনেক মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখছে।


কয়েকজন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘আরে কোনো ব্যাপার না। তুই একটু টেরও পাবি না। খালি মনে হইবো—মনে হইবো যে, একটা লাল পিঁপড়া তোর *** কামড় দিছে।"😒


সম্ভবত আমার খালু বা মামা আমার মাথা শক্ত করে অন্য দিকে ধরে রাখলো,যাতে আমি কিছু না দেখি।হাজাম আমাকে বললো,"দেখতো বাবা, সামনের নারকেল গাছে কয়টা নারকেল ধরেছে।"


আমি তার কথা মতো নারকেল গুনছিলাম,এর মধ্যেই সেই লাল পিঁপড়া আমাকে জোরে কামড়ে দিলো, আমি জোরে কান্না শুরু করলাম.... তারপর অনেক দিন আমাকে লুঙ্গি উঁচু করে চলতে হয়েছে!😒 


#ছেলেবেলার_স্মৃতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.