ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি

এক বন্ধুর সাথে বড়ই ফল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণ পাশে দুইটা বেশ বড় খোলা (ধান, সরিষা বা অন্য ফসল মাড়াই করার জায়গা) ছিল। অনেক দূর থেকে মহিষের গাড়ি করে এই খোলাতে বিভিন্ন ফসল এনে সেগুলো মাড়াই করা হতো। তখন এলাকার সব রাস্তা ছিল কাঁচা। বৃষ্টির সময় মহিষের গাড়ি এই কাঁচা রাস্তায় চলতে চলতে কাঁদায় আটকে যাওয়া ছিল খুব নিয়মিত ব্যাপার।আমরা এগুলোকে বলতাম 'গাড়ি গেড়ে যাওয়া'। কখনো এভাবে কাঁদায় গাড়ি গেড়ে গেলে আমরা দৌড়ে সেখানে যেয়ে কিভাবে কাঁদা থেকে গাড়ি উঠায় সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। আবার অনেক সময় গাড়ির পেছনে পেছনে যেতাম আর অপেক্ষা করতাম গাড়ি কাঁদায় গেড়ে যাওয়ার। রাস্তায় কিছু কিছু পয়েন্টে গাড়ি গেড়ে যাবে এটা আমরা আগেই থেকেই জানতাম। কারণ কিছু জায়গার রাস্তা ছিল খুবই খারাপ।
ছবি সংগৃহীত
গাড়ি গেড়ে গেলে অনেক সময় ওই গাড়ির মহিষের একটু চেষ্টার পর গাড়ি উঠে যেত। অনেক সময় অনেক চেষ্টা করেও মহিষ গুলো গাড়ি উঠাতে পারতো না। তখন অন্য জায়গা থেকে আরো মহিষে এনে গাড়ি উঠানো হতো। আমাদের পাশের পাড়ার 'সিরাজ উদ্দিনের' (আমরা বলতাম সিরা চাচা) মহিষ গুলো ছিল খুব শক্তিশালী, ওনার গাড়ি খুব কম গাড়তো, আবার অন্যের গেড়ে যাওয়া গাড়ি উঠাতে তার মহিষ ব্যাবহার করা হতো। সুতরাং সিরা কাক্কু এবং তার মহিষ ছিল আমাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়।রাস্তা দিয়ে যখন তার গাড়ি যেত তখন আমরা  দৌড়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর তার মহিষ দেখতাম এবং তার মহিষের প্রশংসা করতাম।এই মহিষের গাড়ি গুলো যখন ফসল নিয়ে খোলার দিকে আসতো তখন আমরা অনেক সময় গাড়ির পেছনের বাঁশে ঝুলতাম। গাড়িওয়ালা নিষেধ করতো, তবুও আমরা ঝুলতাম, একসাথে কয়েকজন। অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে গাড়িওয়ালা আমাদের দৌড়িনি দিত।
ছবি সংগৃহীত
গাড়িওয়ালার কাজ হলো শুধু মাত্র ফসল খোলায় এনে নামিয়ে রাখা। এরপর যারা ক্ষেতে থেকে ফসল কেটেছে সেই শ্রমিকরা ফসল মাড়াই করে তা মালিকের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতো। শ্রমিকরা এক বা একাধিক ড্রামের উপর ধান জোরে বাড়ি দিলে শুধু ধান আলাদা হয়ে সামনে পরতো,আর ধানের আটি আলাদা করে রাখতো। সেই আটিতে কিছু কিছু ধান থেকে যেতো। একদম শেষের দিকে সবগুলো ধানের আটি একসাথে মাটিতে বিছিয়ে রাখতো, এরপর দুইটি গরু দিয়ে সেই ধানগুলোকে ভালো ভাবে পা'রানো হতো,যাতে অবশিষ্ট ধান পারে যায়। এরপর সেই ধানের আঁটি গুলো কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে গরুর খাওয়ার উপযোগী করা হতো।
                                                                         ছবি সংগৃহীত
মহিষের গাড়িগুলো যদি ফসল নিয়ে বিকালের দিকে খোলায় আসতো তাহলে আমাদের খুব মন খারাপ হতো, কারণ বিকেলে আসলে সেই ফসল মাড়াই করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যেত, সুতরাং আমরা বিকালে আর খেলতে পারতাম না।এরকম হলে আমরা ফসলের মালিককে বারবার বলতাম তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য। অথবা গাড়ি ধান নিয়ে আসলে সেই গাড়ি থেকে ধানের আঁটি গুলো আমরা সবাই নামিয়ে দিতাম যাতে তাড়াতাড়ি হয়। আর যদি খেলার সুযোগ না'ই পেতাম তাহলে অন্য কিছু খেলতাম।ফসল মাড়াই শেষে শুধু গাছ গুলো একপাশে বড় স্তুপ করে রেখে দেয়া হতো।আমরা গাছে উঠে এই স্তুপের উপর লাফ দিয়ে পড়তাম, আবার উঠতাম আবার নীচে লাফিয়ে পড়তাম। অথবা এই স্তুপের ভেতর লুকিয়ে থেকে লুকোচুরি খেলতাম। অবশ্য এইগুলোর জন্য পরে বাসায় বকা খেতে হতো।
ছবি সংগৃহীত
আমাদের স্কুল জীবনের পুরোটা সময়ের খেলাধুলা এই খোলাকে কেন্দ্র করে চলেছে। তালগাছের ব্যাট সাথে ৫টাকার প্লাস্টিকের বল আর গাছের ডাল দিয়ে স্ট্যাম্প দিয়ে ক্রিকেট, গোল্লা ছুট,চোর পুলিশ,বউচি, লুকোচুরি, কানামাছি, ডাঙ্গুলি এইরকম আরো অনেক খেলা এই এখানে খেলেছি।এই খোলার মাঝখানে সারিবদ্ধভাবে ৭-৮টি বেশ বড় বড় হিজল গাছ ছিল। বর্ষার মৌসুমে সকাল বেলায় হিজল গাছের নীচে পড়ে থাকতো অজস্র বিভিন্ন রঙের হিজল ফুল। কোন গাছের ফুলের রং লাল,কোনটা সাদা অথবা কোনটা হলুদ রঙের ফুল। সকাল বেলা গাছের নীচে গেলে দখিনা মৃদু হাওয়া আর সাথে হিজল ফুলের গন্ধ ভিন্ন এক জগতের পরিবেশ তৈরি করতো। আমি এখনো সেই মুহূর্তটাকে অনুভব 
করতে পারি।
ছবি সংগৃহীত
এই খোলার পাশেই একটি উঁচু টিলা ছিল।আমরা একে বলতাম জৈগুনের ভিটা (জৈগুন একজন বিধবা নারী)।ওই টিলার উপরে একটি পরিত্যক্ত কুড়ে ঘর ছিল। এই ভিটায় যাওয়া ছিলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, কারণ এখানে ভূত এবং বড় বড় সাপ থাকে। খুব ছোট বেলা থেকেই আমাদের এভাবেই বুঝানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ভিটাকে ঘিরে অনেক ভৌতিক গল্পও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি।তাই ওই ভিটাকে আমার খুব ভয় পেতাম, কখনো সেখানে উঠতাম না। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যদি কারো বল সেখানে যেত তাহলে তাকেই ওখান গিয়ে বল আনতে হতো।
ছবি সংগৃহীত
এই খোলার পাশেই ছিল এক ব্যক্তির চারটি বড়ই গাছ। প্রতিটি গাছের বড়ই ছিল খুব সুস্বাদু। আমি গাছের উঠতে পারতাম না, তবে আমাদের মধ্যে কয়েকজন খুব ভালো গাছে উঠতে পারতো। গাছের মালিক ওদের বড়ই গাছে উঠে গাছ ঝাঁকি দিতে বলতো।উপর থেকে গাছ ঝাঁকি দিলে নীচে শত শত হাজার হাজার বড়ই একসাথে ঝরে পড়তো। নীচে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা সেই বড়ই কুড়িয়ে গাছের মালিকের ঝুড়িতে রেখে দিতাম। সব বড়ই কুড়ানো শেষ হলে মালিক আমরা যারা বড়ই কুড়িয়েছি তাদেরকে কিছু কিছু দিত। এটা হচ্ছে বৈধ পন্থায় অন্যের বড়ই খাওয়া। অন্য একটা অবৈধ পন্থাও ছিল। সেটা হচ্ছে, খেলার সময় হঠাৎ করেই বড়ই গাছে ঢিল ছুঁড়ে দিতাম। এরপর সবাই দৌড়ে গিয়ে বড়ই কুড়াতাম। কখনো ঢিলের শব্দ শুনে গাছের মালিক চলে আসতো, তখন আমরা বড়ই না কুড়িয়ে আবার খেলা শুরু করতাম, ভাব নিতাম কিছুই হয়নি। মালিক চলে গেলে দৌড়ে গিয়ে আমরা আবার বড়ই কুরাতাম।কখনো যদি ঢিল খুঁজে না পেতাম তাহলে পায়ে জুতাটাই গাছের দিকে ছুঁড়ে দিতাম, অনেক সময় জুতা গাছের কাঁটায় আটকে থাকতো। সেই জুতা নিচে ফেলার জন্য আবার জুতা বরাবর ঢিল নিক্ষেপ করতে হতো।
ছবি সংগৃহীত
এগুলো কিছুই এখন নেই, কোন গাড়ি এখন রাস্তায় কাঁদায় আটকে যায় না, কারণ সব রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। নেই কোন মহিষের গাড়ি, এগুলো সব এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই হিজল গাছ এবং বড়ই গাছগুলো বহু আগেই কেটে ফেলা হয়েছে, আর সেই ভয়ঙ্কর জৈগুনের ভিটাতে এখন বাড়ি হয়েছে।সেই খোলাগুলোতে এখন আর কেউ ফসল আনে না,কারণ ফসল এখন যার যার জমিতেই মাড়াই করা হয়।আর তাই খোলা গুলো এখন ভরাট করে বাড়ি করা হয়েছে অথবা গাছ লাগানো হয়েছে এবং এই ভরাট হয়ে যাওয়া খোলার সাথে চাপা পড়ে গেছে ছোটবেলার সব খেলাধুলা,যার কিছুই এখন নেই।
                                                                        ছবি সংগৃহীত
কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিনগুলো!! কত সুন্দর নির্ভাবনার দিন ছিল তখন। যদি অতীত অথবা বর্তমান বেছে নেয়ার কোন সুযোগ পেতাম কখনো, তাহলে আমি আল্লাহকে বলতাম," আমাকে আমার ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন।এই ব্যস্ত সময়ের যান্ত্রিক মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় আর পেরে উঠছি না,আমি খুব ক্লান্ত।"
                                                                            ছবি সংগৃহীত                 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.