Yellow Flowers on the Green Grass (2015)

Country:Vietnam

আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তখন আমাদের বাসায় সাদাকালো একটি টিভি ছিল।পুরো পাড়াতে তখন আর কোন টিভি ছিল না।আর তাই সবাই আমাদের বাসায় আসতো টিভি দেখতে। সমবয়সী ছেলেদের মাঝে নীজেকে তখন রাজা রাজা মনে হতো। মানে কেউ তখন আমার সাথে ঝামেলা করতে আসতো না। কারণ ঘুরেফিরে তখন আমাদের বাসাতেই সবাইকে টিভি দেখতে আসতে হতো।তাই যামেলা করা মানে সে আমাদের বাসায় আর আসতে পারবে না।

তখন বিটিভি তে অনেক কার্টুন হতো। শুক্রবার সকালে এবং সপ্তাহে অন্য কয়েকদিন বিকালে ওই কার্টুন প্রচার হতো। কার্টুন শুরু হবার মূহুর্তে আমি দরজা জানালা ভালো ভাবে বন্ধ করে দিয়ে টিভির সামনে বসে একা একা কার্টুন দেখতাম।এটা এক অন্যরকম অনুভুতি, কারণ অন্য সব পোলাপান বাড়ির আশপাশে ঘুরা ঘুরি করছে একটু টিভি দেখার জন্য, কিন্তু কেউ দেখার সুযোগ পাচ্ছে না।

আমাদের বাড়ি ছিল তখন টিনের,আর দরজা জানালা ছিল কাঠের।টিনে বেশ কিছু ছিদ্র ছিল,আর দরজা জানালাতেও কিছু ফাকা স্পেস ছিল।ওইগুলোতে চোখ লাগিয়ে পোলাপান পালাক্রমে টিভি দেখার চেষ্টা করতো,মানে কিছুক্ষণ একজন তারপর আরেকজন। আমি টিভির খুব সামনে চেয়ার নিয়ে এমন ভাবে টিভিকে আড়াল করে বসতাম যাতে ছিদ্র দিয়ে চোখ লাগিয়েও কেউ টিভি দেখতে না পারে। তবুও পোলাপান নানা ভাবে চেষ্টা করতো একটু টিভি দেখার। সবসময় যে এমন একা একা দেখতাম তা না, অনেক সময় সবাইকে নিয়েও টিভি দেখতাম।

মুভি রিভিউ লিখতে গিয়ে আমার ছোট বেলার গল্প কেন বললাম?বললাম কারণ আজকে এমন একটি মুভির কথা বলবো যে মুভির গল্পের ভেতর এমন কিছু বিষয় আছে যা আমাদের ছোটবেলায় ফেলে আসা দিনগুলোর সাথে পুরোপুরি মিল আছে।এটা এমন একটা মুভি যেটা দেখতে বসলে মুহূর্তেই আপনি হারিয়ে যাবেন আপনার ফেলে আসা ছেলেবেলায়। নিমিষেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে আপনার শৈশবের স্মৃতিগুলো।

বলছিলাম ভিয়েতনামের চলচ্চিত্র Yellow flowers on green grass এর কথা।এই চলচ্চিত্রে এক খল চরিত্রের নাম হচ্ছে সন,যার সাথে আমার উপরে বর্ণিত ঘটনার বেশ মিল আছে।

মুভির এক দৃশ্যের দেখা যায় সন টিভির সামনে বসে কার্টুন দেখছে এবং খাচ্ছে, আর একা একাই হাসাহাসি করছে।বাইরে তখন তার সমবয়সী বা তার থেকে ছোট অনেকগুলো পোলাপান দরজা, জানালায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে টিভি দেখার চেষ্টা করছে।

সন দেখতে বেশ মোটা এবং ক্লাসের সবার চেয়ে বড়।মোটা সহপাঠীর কথা বলতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। স্কুল-কলেজ জীবনে বিশেষ করে স্কুলে জীবনে একটু মোটা আর লম্বা সহপাঠী দেখে সাধারণত আমরা একটু ভয় পেতাম।তারা সবসময় তাদের শারীরিক ভাবে শক্তিশালী হবার সুবিধা নিতো। সনের আচরণও ক্লাসের সবার সাথে এমন'ই।সে তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী হবার কারণে সবার উপর কর্তৃত্ব করে,অযথা মাতব্বরি করে,অহেতুক মারামারি করে,তাই সবাই তাকে ভয় পায়।

এই মুভির গল্পটি মূলত দুই ভাই থিয়াও এবং তং কে নিয়ে।থিয়াও বড় ,সে আবার পছন্দ করে তার একই ক্লাসে পড়া মান কে। থিয়াও খুব ইন্ট্রোভার্ট, অনেকটা আমার মতো।মনে অনেক কথা, কিন্তু বলার সাহস নেই,তাই শুনারও মানুষ নাই... বলার সাহস না থাকলে শুনার মানুষ কিভাবে আসবে,তাই না? ইন্ট্রোভার্টদের মনের কথা প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলো লেখা। যেখানে সে ইচ্ছে মতো তার মনের কথা লিখতে পারে।কে শুনবে বা কে অবহেলা করবে সেই চিন্তা তাকে করতে হয় না।

থিয়াও একদিন মানকে চিঠি লিখে। খুব বেশি কিছু লিখে না, শুধু দুইটা লাইন লিখে,"আমার পরানো যাহা চায়, তুমি তাই তাই গো।" এখানে কথা খুব কম হলে কি হবে,বুঝলে এখানেই অনেক কথা খুজে পাওয়া যাবে। স্কুলের বারান্দায় বসে থিয়াও চিঠিটা লেখা যখন শেষ করে ঠিক তখন হঠাৎ করেই সেই মোটকু সন চলে আসে।এসেই সে থিয়াও এর হাত থেকে চিঠিটা টান দিয়ে নিয়ে নেয়। এরপর বলে

-"কিরে প্রেমের চিঠি নাকি! কাকে দিবি?ওহ মানকে!! দে তর সব মার্বেল আমাকে দে।"

-" আমার মার্বেল তোকে দিবো কেন?"

-"তর চিঠি আমি মানকে পৌঁছে দিবো,তার ভাড়া"

-"আমার চিঠি আমিই দিতে পারবো।"

-"তাড়াতাড়ি দে"

বেচারা নিরিহ মানুষ থিয়াও আর কি করবে!,পকেট থেকে সব মার্বেল বের করে সনকে দিয়ে দেয়।

সন সেই চিঠি মানকে পৌঁছে দেয় ঠিকই, তবে এমন ভাবে পৌঁছে দেয় যার জন্য থিয়াও ক্লাসে বড় ঝামেলায় পড়ে যায়।

এরপর একদিন সন থিয়াওকে স্কুলের পেছনে জোর করে ধরে নিয়ে বলে," 

-"তুই আর মানের আশপাশে যাবি না"

-"যাবো না কেন?"

-"মানকে আমি পছন্দ করি, ও শুধু আমার।"

-"মান আমার,সে কখনো তর হবে না"

এই কথা শুনার পর সন থিয়াওকে ইচ্ছে মতো পিটায়। বাসায় আসার পর তার ছোট ভাই তং বড় ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে সনকে শায়েস্তা করার বুদ্ধি বের করে। কিন্তু এটা এতো সহজ না, কারণ সন অনেক মোটা আর তাদের থেকে শক্তিশালী।

আরেক দৃশ্যে দেখা যায় তারা দুই ভাই ভূতের গল্প শুনে রাতে ঘুমানোর সময় খুব ভয় পায়। ছোটবেলায় এরকম একটা স্মৃতি আমারও আছে। আমার বড় চাচার বাসা আমাদের বাসার ঠিক পেছনেই। আমার বড় চাচী অনেক ভালো ভূতের গল্প বলতে পারতো। ঠিক গল্প না, এগুলো নাকি উনার নিজের অভিজ্ঞতা। মানে উনি নিজে যা দেখেছেন তাই আমাদের সাথে শেয়ার করতো।

তো মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার পর পড়াশোনা শেষ করে আমরা দুই ভাই চাচার বাসায় যেতাম ভূতের গল্প শুনতে, গল্প শুনা শেষ হলে আব্বা গিয়ে আমাদেরকে আবার বাসায় নিয়ে আসতো। এরপর আমরা দুই ভাই যখন ঘুমাতে যেতাম তখন মাথায় সবসময় ভূতের ভয় চলতে থাকতো। কখনো কখনো ভয়ে দুইজন কাঁথার নীচে  লুকিয়ে থাকতাম।

আবার মুভির এক দৃশ্যে দেখা যায় ওই দুই ভাই গাছের পাতা দিয়ে বানানো চরকি উড়াচ্ছে। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমাদের বাসার দক্ষিণ পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে তিব্র বেগে দখিনা বাতাস আসতো।আমরা তখন আম গাছের পাতা বা নারকেল পাতা দিয়ে বানানো চরকি উড়াতাম। আমি চড়কি বানাতে পারতাম না, বেশির ভাগ সময় আমার মামা বা অন্য কেউ বানিয়ে দিতো।

আম পাতা দিয়ে চরকি বানালে চরকির পাখা হতো দুইটা,আর নারকেল পাতা দিয়ে বানালে পাখা হতো চারটা।চরকি বানানো শেষে তাতে একটি চিকন কাঠি দিয়ে বাতাসের দিকে চরকি ধরে রাখতাম, এরপর সেটা ঘুরতো। কখনো চরকির সামনে মুখ নিয়ে দেখতাম ঘুরার কারণে মুখে বাতাস লাগে কিনা, আবার কখনো কখনো পাখার মাঝে আঙ্গুল দিয়ে পাখা বন্ধ করে দেখতাম গতির কারণে আঙ্গুলে ব্যথা পাওয়া যায় কিনা বা কতটা তীব্র গতিতে চড়কি ঘুরছে।কি মজার ভাবনাহীন দিন ছিল তখন।

অবশ্য কিছু ঝামেলা ওই বয়সেও ছিল। সারাদিন শুধু পড়ালেখার চাপ ছিল, পড়ার চাপের কারণে তখন খুব খারাপ লাগতো। কারণ পড়তে ভালো লাগতো না। মানুষের চিন্তা ভাবনা খুব অদ্ভুত।আমরা বর্তমান সময়ে যখন থাকি তখন বর্তমান সময়কে ভালো লাগে না, কিছু সময় পর যখন এই বর্তমান'টাই অতীত হয়ে যায়, তখন মনে হয়,"আরে আগের সময়টাই তো কত ভালো ছিল।সময়টা কেনো সেখানে থমকে থাকলো না!"

প্লট:১৯৮০ দশকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ভিয়েতনামের এই মুভিটি একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের দুই ভাইকে কেন্দ্র করে নির্মিত। খুব অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া দুই ভাই থিয়াও এবং তং।বাবা, মা সহ তারা থাকে ভিয়েতনামের পাহাড়ি অঞ্চলে। দুই ভাইয়ের বয়স হবে ১০-১৪ বছরের মধ্যে।তারা দুইজন সারাদিন একসাথে থাকে, কখনো স্কুলে যায়, কখনো বা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়,মাছ ধরে, সবুজ ঘাসে হাঁটে, প্রজাপতির পেছনে ছুটে, কখনো বা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে তাদের সারা দিন কেটে যায়। তারপর রাতে দুই ভাই একসাথে ঘুমিয়ে থাকে,ঘুমের আগে দুজন অনেকক্ষণ গল্প করে, সারাদিন কি করলো না করলো‌ এইগুলো নিয়ে।

মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়, কখনও কখনও মারামারিও হয়। তবে ঝগড়া বা মারামারি বেশিরভাগ সময় হয় বড় ভাইয়ের জন্য।ছোট ভাই তং খুব বুদ্ধিমান ও শান্ত এবং সে বই পড়তে খুব ভালোবাসে।

সে তার বড় ভাই থিয়াওকে খুব ভালোবাসে।তং যদি তার বড় ভাই দ্বারা কখনো আঘাত পায় সেটা সে কখনো বাড়িতে এসে বলে না,সে চায় না তার কারণে তার ভাই বাবা মায়ের কাছে বকা খাক।তং এর সাথে তুলনা করলে থিয়াও অনেক স্বার্থপর।

বড় ভাই থিয়াও পছন্দ করে তার সাথে একই ক্লাসে পড়া মানকে। ছোট ভাইও একটি মেয়েকে পছন্দ করে এবং সেই মেয়ের সাথে সে মাঝে মাঝে কথা বলে। তং তাকে রাজকন্যা বলে। তবে মানুষের কাছে এই রাজকন্যার কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ জানে না রাজকন্যা সত্যি কিনা,সে কোথা থেকে আর কোথায়ই বা চলে যায়। একমাত্র তং তার রাজকন্যার অস্তিত্ব জানে।তং এর রাজকন্যার পরিচয় আমরাও গোপন রাখি।তার গোপন কথা গোপনই থাক।

মুভির এক পর্যায়ে এসে মানকে কেন্দ্র করে দুই ভাইয়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়।যেখান থেকে তাদের মধ্যে তৈরি হয় রাগ, অভিমান, হিংসা এবং তারপর বড় রকমের দূর্ঘটনা ঘটে যায়। এরপর শুরু হয় তাদের এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ,যার ফলে তাদের পরিবার এবং পুরো গ্রামকে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে হয়।

শেষ কথা: Yellow Flowers on the Green Grass শিশুদের নিয়ে তৈরি করা আমার দেখা সেরা মুভি। মুভিটি দেখার সময় বারবার আপনাকে আপনার ছোট বেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মুভির গল্পটি খুব শক্তিশালী এবং গোছালো আমি তা বলবো না। তবে এর মেকিং অসাধারণ, মেকিংয়ের কারণে গল্পের অগোছালো ভাব চোখে পড়বে না। অভিনয়ের কথা বলতে গেলে,সবার অভিনয় ছিল খুবই ভালো।বিশেষ করে প্রধান তিনটি শিশু চরিত্রের অভিনয় ছিল একেবারেই বাস্তবিক।

এই মুভির পরিচালক ভেক্টর ভুও,এই ভদ্রলোকের আরেকটি মুভি কিছুদিন আগে দেখেছি,Mat Biec (Dreamy Eyes)।এটাও আমার কাছে খুব ই ভালো লেগেছে। উনার মুভির একটা বিশেষত্ব হলো উনি তার মুভিতে ছেলেবেলা, ছেলেবেলা স্মৃতি,গ্রাম, প্রকৃতি, ঐতিহ্য এইগুলো খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে।ভেক্টর ভুও তার তৈরি মুভিতে তার কল্পনার জগতটাকে এমন সুনিপুণ ভাবে উপস্থাপন করে যা আমি খুব কম পরিচালকের মাঝে দেখেছি।

Yellow Flowers on the Green Grass মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমাটোগ্রাফি এবং কিছু ড্রোন শট এতোটাই দৃষ্টিনন্দন ছিল যে মুভি চলার সময় স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করবে না।এই মুভিতে এতো সুন্দর ভাবে ভিয়েতনামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে যে এই মুভি দেখার পর ভিয়েতনামের নাম দেখলে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে সবুজ দিগন্ত,নির্জন পাহাড়, একেবারে বয়ে চলা নদী, মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া কিছু সবুজ ঘাস,আর তাতে কিছু হলুদ ফুল।

একটি ভালো মুভির স্বার্থকা মনে হয় এখানেই,সে খুব সহজেই আমাদের কল্পনার জগতে প্রবেশ করে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করতে বাধ্য করে।

আপনার মনে হতে পারে মুভির রিভিউ লেখার ছুতোয় আমার জীবনের কিছু গল্প বলে গেলাম।ওই যে বললাম, ইন্ট্রোভার্ট মানুষের মনের কথা প্রকাশ করার সবচেয়ে আপন মাধ্যম হচ্ছে লেখা।তাই লেখা শুরু করলে থামতে ইচ্ছে করে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.