️Instructions Not Included (2013)

Country:

Mexico
কলিং বেল বাজছে।
কলিং বেলের শব্দে ভ্যালেন্টিনের ঘুম ভেঙে গেল।
ভ্যালেন্টিন ছেলেটা কিছুটা অসামাজিক, কিছুটা না বলা যায় বেশ ভালই অসামাজিক। একজন মানুষকে অসামাজিক বলতে গেলে যতগুলো কারণ থাকা প্রয়োজন তার সবই তার মধ্যে আছে। যেমন, মদ, নারী, পার্টি তার নিত্যদিনের সঙ্গী।প্রায় নিয়মিত ভাবেই সে তার বান্ধবী পরিবর্তন করে।এই যেমন দেখেন, গত রাতে বুকের দুই পাশে দুই বান্ধবীকে নিয়ে সে ঘুমিয়ে ছিল।

সেই আরামদায়ক ঘুম কলিং বেলের শব্দে ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙ্গার পর একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে বিছানা থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে ভ্যালেন্টিন দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে দেখে এক সুন্দরী নারী ছোট এক শিশুকে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল;

-আপনি ভ্যালেন্টিন?
-জি, কিন্তু আপনি কে? কাকে চান?
-আমি জুলি, আমাকে চিনতে পারছ না!!
-জুলি? (তার অবশ্য চেনার কথাও না)
-ওইযে দেড় বছর আগে আমি ছিলাম তোমার ভালোবাসার মানুষ।
-ও হ্যাঁ, জুলি, (অনেকটা চেনার ভান করল সম্ভবত) তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?এটা কি তোমার বাচ্চা? খুব সুন্দর হয়েছে তো বাচ্চাটা। ঠিক তোমার মত।
-আরে গাধা এটা তোমার মেয়ে।
কথা শুনে তো ভ্যালেন্টিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
-কিন্তু আমাদের তো বাচ্চা নেয়ার কথা ছিল না।
-আচ্ছা তুমি ওকে একটু তোমার কাছে রাখো, আর আমাকে কিছু টাকা দাও, আমি টেক্সির ভাড়া দিয়ে আসছি।

ভ্যালেন্টিনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জুলি ট্যাক্সি ক্যাবের ভাড়া মেটাতে গেল। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও জুলি আর ফিরে আসছিলো না। হঠাৎ ভ্যালেন্টিনের বাসায় জুলির ফোন করে বলল ''এখন থেকে বাচ্চাটাকে তুমিই লালন-পালন করবে।কারণ আমি বাচ্চাটাকে আর রাখতে পারবে না।"

জুলির কথা শুনে ভ্যালেন্টিন খুব ভয় পেয়ে যায়। কারণ সে ছোটবেলা থেকেই খুবই ভিতু,সে সব কিছুতেই প্রচন্ড ভয় পায়। তবে সে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কমিটমেন্টকে। তার কোন বান্ধবী যখন তাকে জিজ্ঞেস করে:

-আচ্ছা জান, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো।
-হ্যাঁ জান, অবশ্যই ভালবাসি।
-কেন তুমি আমাকে ভালোবাস?
-কারণ তুমি সবার থেকে আলাদা।
-তাহলে আমাকে বিয়ে করবে??

এই কথা শুনার পারে মেহেদি কাপড়-চোপড় নিয়ে দৌড়ে রুম থেকে পালিয়ে যায়। কারণ সে একা একা নিজের মত করে জীবন যাপন করতে চায়, কোন কমিটমেন্টে সে জড়াতে চায় না।আর এই জন্যই দশ মাসের বাচ্চার দায়িত্ব যখন তার কাঁধে এসে পড়ে তখন তার সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়।

জুলির রেখে যাওয়া বাচ্চার সাথে থাকা একটি ছবি থেকে ভ্যালেন্টিন বুঝতে পারে জুলি আমেরিকার একটি হোটেলে কাজ করে।

তাই ভ্যালেন্টিন সিদ্ধান্ত নেয় সে মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় যাবে। সেখানে গিয়ে জুলিকে খুঁজে বের করে তার বাচ্চা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে মেক্সিকোতে ফিরে এসে সে আবার তার আমোদ প্রমোদের জীবন যাপন শুরু করবে।

অনেক সংগ্রামের পর আমেরিকার সেই হোটেলে এসে ভ্যালেন্টিন বাচ্চাটিকে নিচ তলায় রেখে সে ১০ তলায় যায় জুলিকে খোঁজ করতে।১০ তলায় উঠার পর সে হঠাৎ করে খেয়াল করে দেখে সেই বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে সুইমিং পুলের দিকে যাচ্ছে...তখন নীচ তলা খালি, কেউ নেই। ভ্যালেন্টিন চিৎকার করে বাচ্চাটাকে থামতে বলছে, কিন্তু বাচ্চার কানে তার সেই চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না।

উপায়ান্তর না দেখে কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই ভ্যালেন্টিন ১০ তলা থেকে একদম নিচের তলায় থাকা সুইমিং পুলে লাফ দেয়। অথচ তার কিন্তু উচ্চতা ভীতি আছে এবং যে বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্য সে ১০ তলা থেকে লাফ দিয়েছে, সেই বাচ্চাটিকে তার মায়ের কাছে রেখে যাওয়ার জন্য সে সেই মেক্সিকো থেকে আমেরিকা চলে এসেছে...এই বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য তার তো নিজের জীবন বাজি রাখার কথা না।

যাইহোক,সেই হোটেলে ভ্যালেন্টিন জুলিকে খুঁজে পাইনি।তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় জুলিকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে আমেরিকাতেই অবস্থান করবে।

বেঁচে থাকার জন্য সে সিনেমার স্ট্যান্টম্যানের কাজ করতে শুরু করে ও সেই বাচ্চাটিকে লালন পালন করতে থাকে এবং একই সাথে জুলিকে খুঁজতে থাকে, বাচ্চাটিকে তার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য।

এরপর থেকে বাবা মেয়ের জীবন যাপন বেশ সুখে শান্তিতেই চলছিল... ভ্যালেন্টিন হয়তো একসময় পিতৃত্বের স্বাদ বুঝতে পারে। ভ্যালেন্টিন তার মেয়েকে এক ফ্যান্টাসি জগতের মধ্যে রেখে বড়ো করতে থাকে...যে জগতে আছে শুধু জুলি, ভ্যালেন্টিন এবং তাদের মেয়ে ম্যাগি আর তাদের অদ্ভুত কিছু কল্পনা।

ভ্যালেন্টিন এখন আর জুলির জন্য অপেক্ষা করে না, এমনকি সে চায়ও না তাদের জীবনে জুলি আবার ফিরে আসুক।সে নিজেই তার সর্বোচ্চ দিয়ে মেয়েকে বড়ো করতে থাকে। কিন্তু একসময় তাদের বাবা-মেয়ের জীবনে নেমে আসে এক কালো মেঘ...যে মেঘ তাদের সব সুখ অন্ধকারে ঢেকে দেয়.....

আগেই বলেছি ছোটবেলা থেকেই ভ্যালেন্টিন খুবই ভিতু। সে সব কিছুতেই প্রচন্ড ভয় পায়।ভয় পাওয়ার এই অভ্যাস তার বড় হবার পরও হয়ে গেছে। তবে সে খুব ভীতু হলেও যখন তার মেয়ের ভালো লাগা এবং খুশির প্রশ্ন আসে তখন সে হয়ে যায় পৃথিবীর সবচাইতে সাহসী মানুষ। একটি ঘটনা বলি যাতে বুঝা যাবে ভ্যালেন্টিন আসলে  কতটা সাহসী পিতা এবং সে কতটা তার মেয়েকে ভালবাসে।

ভ্যালেন্টিন ইংরেজি জানে না, তাই শুটিং স্পটে তার মেয়ে ম্যাগি তার জন্য দোভাষীর কাজ করে। একদিন এক প্রযোজক অথবা পরিচালক ভ্যালেন্টিনের মেয়েকে বলে, "তোমার বাবা কি ১০ তলা থেকে লাফ দিতে পারবে?"

ম্যাগি বলে, "হ্যাঁ পারবে, আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গা থেকেও লাফ দিতে পারবে।" (সে তার বাবাকে নিয়ে খুব গর্ব করে)।

তবে ম্যাগি এই কাজের জন্য বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক চায়, পরিচালক অবশ্য তাতে রাজিও হয়।

ম্যাগি তার বাবাকে গিয়ে ১০ তলা থেকে লাফ দেয়ার কথা বললে তার বাবা বলে" না, না, তাকে বলে দাও এটা সম্ভব না। আমি ৪ তালার বেশি উপর থেকে লাফ দিতে পারব না।"

কিন্তু মেয়ে পরিচালকের কাছে এসে জানায় তার বাবা রাজি হয়েছে।ভ্যালেন্টিনকে জোর করে ধরে দশতলায় উঠানো হলো, কিন্তু সে কিছুতেই সেখান থেকে লাফ দিবে না। পরিচালক বুঝতে পারে ম্যাগি তার সাথে মিথ্যা কথা বলেছে।এজন্য ম্যাগিকে পরিচালক বকা দিচ্ছিল, এটা উপর থেকে ভ্যালেন্টিন দেখে জানায় সে ১০ তলা থেকেই লাফ দিবে এবং চোখ বন্ধ করে সে ১০ তলা থেকে নিচে লাফ দেয়... শুধুমাত্র তার মেয়ের খুশির জন্য...

পুরো মুভিতে এই রকম আরো অনেক ঘটনা আছে যা দেখে মনে হবে ভ্যালেন্টিন তার মেয়েকে কতটা ভালোবাসে। তাকে শুধুমাত্র একজন অসামাজিক মানুষ বললে ভুল হবে, সেইসাথে সে একজন ভালো বাবা এবং অবশ্যই একজন ভালো মানুষও বটে।

আর তাই যে মেয়েকে সে ফেরত দেওয়ার জন্য সুদূর মেক্সিকো থেকে আমেরিকা চেল এসেছে, এখন সেই মেয়ের খুশির জন্য সে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে একবারও চিন্তা করছে না।

বাবা মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে তৈরি করা আমার দেখা সেরা মুভি হচ্ছে Instructions Not Included (2013)।হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি মুভি, যা কখনো আপনাকে মন খুলে হাসাবে, আবার কখনো আপনার অজান্তেই আপনাকে কাদাবে।

বাবার চরিত্রে অভিনয় করা Eugenio Derbez এর অভিনয় ছিল অনবদ্য,এর থেকে বেশি অন্য কেউ এই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারতো বলে আমার মনে হয় না।মুভিতে তার অভিনয় দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো।অভিনেতা Eugenio Derbez নিজেই এই মুভির পরিচালক।শুধু তাই নয় তিনি এই মুভির একজন সহকারি স্ক্রিপ্টরাইটার এবং ভিডিও এডিটর।এই ভদ্রলোক একাধারে একজন অভিনেতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার, পরিচালক এবং প্রযোজক। তাকে স্প্যানিশ ভাষায় সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতা হিসেবে ধরা হয়।

এছাড়া ম্যাগি চরিত্রে অভিনয় করা ছোট মেয়েটির অভিনয়ও ছিল খুব সাবলীল।এই মুভির আরেকটি অন্যতম সুন্দর দিক ছিল এর অসাধারণ সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি।

৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই ছবিটি আয় করেছে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।এটি মেক্সিকোর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আয় করা মুভি।এই মুভিটি এখন পর্যন্ত ফ্রান্স এবং ব্রাজিলে রিমেক করা হয়েছে।

Instructions Not Included মুভিটা আমার খুঁজে পাওয়া না। ফ্রেন্ডলিস্টের একজন আমাকে বলেছিল ভাইয়া এই মুভিটার লিংক দিয়েন। নাম দেখে আমি ভাবলাম এটা আবার কেমন নাম!! পরে গুগলে সার্চ করে দেখি এটা একটা মেক্সিকান মুভি। ডাউনলোড করে কয়েক মাস রেখে দিয়েছিলাম, তখন দেখিনি, কিছুদিন আগে দেখেছি ।

যাইহোক,সব শেষে বলতে পারি একজন মানুষ ভিতু হতে পারে, দুর্বল হতে পারে, অসামাজিক হতে পারে, আর্থিকভাবে অসচ্ছলও হতে পারে। কিন্তু সেই মানুষটি যখন বাবা হয় এবং তার সামনে যখন তার সন্তানের খুশি এবং ভালো লাগার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, তখন সেই ভীত এবং দুর্বল মানুষটিই হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষ।সে চেষ্টা করে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিসটি তার সন্তানকে দেয়ার জন্য, যদিও সেটা তার সাধ্যের বাইরে....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.